অন্ধ ও দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জন্য পড়ালেখার বিশেষ পদ্ধতির নাম ব্রেইল। এর আবিষ্কারক লুইস ব্রেইল। আজ তাঁর জন্মদিন। লুইস ব্রেইলের জন্মদিনে প্রতিবছর সারা বিশ্বে বিশ্ব ব্রেইল দিবস পালন করা হয়। ব্রেইল পদ্ধতি সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা গড়ে তোলাই ব্রেইল দিবস পালনের প্রধান উদ্দেশ্য।
লুইস ব্রেইল ১৮০৯ সালের ৪ জানুয়ারি প্যারিসের নিকটবর্তী কুপভেরি নামের একটি ছোট শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁকে সম্মান জানাতেই তাঁর জন্মদিনে ব্রেইল দিবস পালন করা হয়। ব্রেইল তিন বছর বয়সে অন্ধ হয়ে যাওয়ার পর ২০ বছর বয়সে অন্যান্য অন্ধ ব্যক্তিকে শিক্ষা দিতে অগ্রসর হন। ১৮২৭ সালে তিনি প্রথম ব্রেইল পদ্ধতির বই প্রকাশ করেন। তবে সে সময়ের দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীরা প্রথম দিকে এই মোটা কাগজে ডটের সাহায্যে লেখাপড়ার পদ্ধতিটি অনুধাবন করতে পারেননি। ১৮৩৭ সালে প্রকাশিত দ্বিতীয় সংস্করণটি ছিল আধুনিক যুগে বিকশিত প্রথম ক্ষুদ্র বাইনারি লিখন পদ্ধতি।
ছয়টি বিন্দু দিয়ে ব্রেইল পদ্ধতিতে লেখা হয়। এ উপায়ে ৬৩টি নকশা তৈরি করা যায়। একেকটি নকশা দিয়ে বিভিন্ন বর্ণ, সংখ্যা বা যতিচিহ্ন প্রকাশ করা হয়। ৬টি বিন্দু বাঁ ও ডান, দুটি উল্লম্ব স্তম্ভে সজ্জিত থাকে; অর্থাৎ প্রতি অনুভূমিক সারিতে থাকে দুটি বিন্দু। বিন্দুগুলো পরস্পরের আকার ও দূরত্ব থাকে অভিন্ন। ঐতিহ্যগতভাবে অ্যাম্বুজকৃত কাগজের ওপর ব্রেইল পদ্ধতিতে লেখা হয়। এর বিকল্প হিসেবে এখন অবশ্য বিশেষায়িত টাইপরাইটার ব্যবহার করে সবাই। এ টাইপরাইটারের নাম ব্রেইলার।
ব্রেইলার একধরনের টাইপ মেশিন, যাতে ছয়টি বিন্দুর জন্য ছয়টি বাটন, স্পেসবার, ক্যাপিটাল লেটার ও সংখ্যা বোঝানোর জন্য পৃথক দুটি বাটন থাকে। ব্যাক স্পেস ও পরের লাইনে যাওয়ার জন্যও পৃথক বাটন থাকে। ব্রেইল টাইপরাইটারে শক্ত ধরনের কাগজ ব্যবহার করা হয়। যাতে স্ফুটিত অক্ষরগুলো সহজে ভেঙে না যায়। ব্রেইল ব্যবহারকারীরা রিফ্রেশেবল ব্রেইল ডিসপ্লে ব্যবহার করে থাকেন। এর মাধ্যমে কম্পিউটারের মনিটর, মোবাইলসহ অন্যান্য ইলেকট্রনিক সমর্থনযোগ্য ডিভাইসে পড়তে পারেন। তাঁরা স্লেট অ্যান্ড স্টাইলাসের মাধ্যমে লিখতে বা পোর্টেবল ব্রেইল নোট টেকার বা কম্পিউটারের মাধ্যমে ব্রেইল রাইটারে টাইপ করতে পারেন।
এ বিশেষ শিক্ষাপদ্ধতি আবিষ্কার করে লুই ব্রেইল ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছেন। তাঁর এ আবিষ্কারের কারণেই দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীরা আজ শিক্ষার আলোয় আলোকিত হচ্ছেন। ব্রেইলের নিরলস অধ্যবসায়ে আজ অন্ধদের পৃথিবী দেখাচ্ছে এ পদ্ধতি। তিনি বরাবরই চেয়েছেন, তাঁর মতো দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীরা যেন সমাজের বোঝা হয়ে না থাকেন। তাঁরাও যেন সমাজের অগ্রগতিতে অবদান রাখতে পারেন। এ জন্যই লুইস অন্ধ ও দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের কল্যাণে ব্রেইল পদ্ধতি আবিষ্কার করে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটান।
বর্তমানে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ভাষায় ব্রেইল পদ্ধতিটিকে নিজস্ব ভাষায় তৈরি করা হয়েছে। বাংলাদেশে ব্রেইল প্রকাশনার মাধ্যমে একুশে বইমেলায় দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা বিভিন্ন ধরনের ব্রেইল বই পাচ্ছেন বিনা মূল্যে। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীরা এগিয়ে যাক সব প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে এবং তাঁদের সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য আমরা সবাই সহযোগিতার হাত বাড়াব।
তবে আজও ব্যাংক, হাসপাতাল, রেস্তোরাঁসহ অসংখ্য প্রতিষ্ঠান আছে, যারা তাদের ছাপা জিনিসপত্র গ্রাহকের কাছে ব্রেইল পদ্ধতিতে পৌঁছে দেওয়ার কোনো তাগিদ বোধ করে না। এ নিয়ে কারও কোনো মাথাব্যথা পর্যন্ত নেই। অথচ দৃষ্টিশক্তিগতভাবে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীনদেরও অধিকার আছে তাঁদের মতো করে সব তথ্য জানার। তাঁদের কাছেও স্বাধীনতার স্বাদ পৌঁছে দেওয়া সমানভাবে জরুরি। সাধারণ মানুষ এ সম্পর্কে সচেতন না হওয়া পর্যন্ত তা কোনোভাবে সম্ভব নয়।