অর্থভুবন ডেস্ক
বাংলাদেশের লোকসাহিত্য আয়নার মতো স্বচ্ছ। এতে প্রতিফলিত হয়েছে বিভিন্ন অঞ্চলের আশা-আকাক্সক্ষা, ধ্যান-ধারণা, সাহিত্য-সংস্কৃতি, বিভিন্ন আচার, অনুষ্ঠান ও ধাঁধা। যাতে বিধৃত হয়েছে সামগ্রিকভাবে লোকায়ত বাংলাদেশের মানস চিত্র।
লোকসাহিত্যে ধাঁধা বহু প্রাচীন। নৃ-তাত্ত্বিকদের মতে, আদিম অধিবাসী থেকে শুরু করে বর্তমান শতাব্দী পর্যন্ত পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ধাঁধার প্রচলন আছে। বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগে ধাঁধার বিকাশ ঘটেছে মঙ্গলকাব্যের ভেতর দিয়ে। বাংলাদেশের ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলে তার ভিন্নতা দেখা যায়। লোকসাহিত্যের দৃষ্টিকোণ থেকে এসব ধাঁধা সে অঞ্চলের সজীব প্রাণের সরল ও জীবন্ত উৎস।
নোয়াখালী অঞ্চলের হাটঘাট, প্রান্তর, আর গ্রামগঞ্জ ভরে আছে লোকসাহিত্যের নানা ধাঁধায়। এ অঞ্চলের মানুষের মনে আজও কচিৎ-কদাচিৎ আকাশে বিদ্যুৎ চমকানোর মতো এসব ধাঁধা জ্বলে ওঠে। কোনো বিবাহ অনুষ্ঠানে, গ্রামীণ বৈঠক আর মজলিসে মানুষের মুখে শোনা যায়। নোয়াখালীর গ্রামের মানুষ আজও ধাঁধার মাধ্যমে তাদের অঞ্চলের সংস্কৃতি টিকিয়ে রেখেছে, বিস্মৃতির অতলে ডুবিয়ে দেয়নি।
নোয়াখালী অঞ্চলের ধাঁধা বাংলা লোকসাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। এর স্বাধীন সত্তাটি লোকশ্রুতিবিদের কাছে স্বীকৃত। এ অঞ্চলের ধাঁধা সরস, অন্তর্নিহিত পরিচয় অপ্রত্যক্ষ হলেও বুদ্ধিগম্য। স্থানীয় ভাষায় বলেÑ শোল্লক।
‘বসলে চন্দ ছেঁচলে কড়ি।
এই শোল্লকগা ভাঙ্গাই দিতে
দোয়াদশ ঘড়ি।’
এর মানে হলো মরিচ।
ওই অঞ্চলের আরেকটি বহুপ্রচলিত ধাঁধা
‘জল কুমকুম হানিত ভাসে।
আড্ডি নাই তার মাংস আছে।’
এই ধাঁধাটির উত্তর হলো জোঁক।
পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো এ অঞ্চলের ধাঁধার সন্ধান মেলে আনুষ্ঠানিক ধাঁধা জিজ্ঞাসার আদলে। যেমন :
‘গাছ গা কালা ফুল গা ধলা
গাছের নাম রক্তমালা’
এর মানে হলো মোস্তাক (পাটিবেত)।
নোয়াখালীর বিভিন্ন স্থানে প্রচলিত ধাঁধার শব্দপ্রয়োগ, উপমা, উৎপ্রেক্ষা, রূপক ও চরণ বিন্যাসে ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। যেমন :
‘ওরে ভাই চুড়িয়াক মনা,
গাছের আগায় হৈল হোনা।’
এই ধাঁধার অর্থ হলো খেজুর।
ফেনী থেকে সংগৃহীত একটি ধাঁধা আছে :
‘এক বৈরাগীর এগার ছেলে
চার ছেলে তার কাতুর কুতুর
চার ছেলে তার ঘি মধুর
দুই ছেলে তার সেগুন কাঠ
এক ছেলে তার পাগল নাথ।’
এর ধাঁধায় বোঝাচ্ছে গাই বা গাভী
প্রচলিত কতকগুলো ধাঁধার মধ্যে প্রচ্ছন্ন গল্প লুকিয়ে থাকে। বাস্তব উপলব্ধি, পরিবেশ ও অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে লতিয়ে উঠেছে এসব ধাঁধা। এর গল্পের ভেতর একদিকে যেমন থাকে লুকানো সংস্কার, রসিকতা, তেমনি থাকে বুদ্ধি ও অভিজ্ঞতার মারপ্যাঁচ। এই দুইয়ে মিলে প্রত্যেকটি গল্পমূলক ধাঁধাই স্বকীয়তায় উজ্জ্বল আর হাস্যরসিকতায় ভরপুর। যেমন : এ অঞ্চলে প্রচলিত গোঁসা গানের মধ্যে কিছু শোল্লক প্রতিপক্ষের সামনে উত্তরের জন্য হাজির করা হয়। সে রকম একটি ধাঁধা
‘উরু উরু বুরু বুরু রমণী দেখায় না তার উরু
রমণী দেখায় না তার লজ্জার কারণ!
রমণীরে দেখে সে করিল গ্রহণ।
রমণীকে ধরে যে করল লন্ড ভন্ড ।
তাহা হতে মুক্তি পেতে লাগে দোয়াদশ দন্ড।’
এই ধাঁধার উত্তর হলো বাডিয়া, নিলুজী, চোরকাঁটা বা প্রেমকাঁটা।
এভাবে নিসর্গ, জীবজন্তু, নিত্যব্যবহার্য জিনিসপত্র প্রভৃতি জানা বস্তুকে অজানার মতো করে উপস্থাপিত অনেক শোল্লক আজও টিকে আছে।
ধাঁধার কোনো সুস্পষ্ট রূপরেখা নেই। ধাঁধা কখনো গদ্য, অমিত্রাক্ষর পদ্য বা যেকোনো রূপেই ধাঁধা রচিত হতে পারে। ধাঁধার বিষয়বস্তু প্রাকৃতিক, গার্হস্থ্য ও জীবনের ব্যবহারিক দিককে কেন্দ্র করে গড়ে উঠতে পারে। তবে ধাঁধার সবচেয়ে বড় কথা হলো ধাঁধার প্রচ্ছন্ন ভাব, ইঙ্গিত ও রসোজ্জ্বল চিত্র। এসবই ধাঁধার প্রাণ। ধাঁধার চিত্রধর্মীগুণই ধাঁধাকে সব সমাজে সবকালে আকর্ষণীয় ও চিত্তাকর্ষক করে তোলে।
নোয়াখালী অঞ্চলের সব ধাঁধায় এসব বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। যাতে আমরা আমাদের পূর্ব পুরুষদের কথা মনে করতে পারি।