অর্থভুবন ডেস্ক
নতুন অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে দেশের রপ্তানি খাতে আশাব্যঞ্জক কোনো অর্জন নেই। ২০২২-২৩ অর্থবছরে রপ্তানি আয়ে প্রবৃদ্ধি হলেও অর্জিত হয়নি লক্ষ্যমাত্রা। গত অর্থবছরে রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল পাঁচ হাজার ৮০০ কোটি ডলার। রপ্তানি আয় হয়েছে পাঁচ হাজার ৫৫৬ কোটি ডলার।
এটি অবশ্য দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। আমদানি ও রপ্তানি প্রবৃদ্ধির মধ্যে বড় ধরনের ফারাক রয়ে গেছে। যে হারে পণ্য আমদানি হচ্ছে, সেই হারে রপ্তানি বাড়ছে না। বাজার সম্প্রসারিত হচ্ছে না।
বাজার সম্প্রসারণের উপযুক্ত উদ্যোগ কি আছে? রপ্তানি বহুমুখীকরণ নিয়ে নানা সভা-সেমিনার হয়। কিন্তু বহুমুখী রপ্তানির উপাদান নিয়ে কি কাজ হয়েছে? রপ্তানি বহুমুখীকরণের প্রধান শর্ত পণ্য বহুমুখীকরণ। পণ্য বহুমুখীকরণ ও রপ্তানিযোগ্য পণ্যের নতুন বাজার খুঁজে বের করতে বা নতুন বাজার সৃষ্টি করতে আমাদের বৈদেশিক মিশনগুলো কী কাজ করছে? যদি করে থাকে তার ফল আমরা কতটুকু ঘরে তুলতে পারছি?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রপ্তানিতে একক খাত নির্ভরতার কারণে যেকোনো সময় ঝুঁকিতে পড়বে দেশের রপ্তানি আয়। সেই একই কথা যেন নতুন করে উচ্চারণ করলেন বাংলাদেশ ও ভুটানের জন্য বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর আব্দুলায়ে সেক।
সম্প্রতি মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির ত্রৈমাসিক মধ্যাহ্নভোজসভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে রপ্তানি বহুমুখীকরণের পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। বলেছেন, স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের (এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন) পর বাংলাদেশকে বিশ্ববাণিজ্যে অগ্রাধিকার সুবিধার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে। এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের পর সস্তা শ্রমের অস্তিত্ব থাকবে না। তিনি মনে করেন, দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারক দেশ হওয়ায় এখন বাংলাদেশের জন্য উচ্চমূল্যের এবং জটিল ডিজাইনের পণ্য উৎপাদন শুরু করার সময় এসেছে। এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের পর বাংলাদেশের রপ্তানি ১৪ শতাংশ হ্রাস পেতে পারে, এমন আশঙ্কাও প্রকাশ করেছেন তিনি।
২০২০ সালে বিশ্বব্যাংকের সহযোগী সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশন ‘বিল্ডিং কম্পিটিটিভ সেক্টরস ফর এক্সপোর্ট ডাইভারসিফিকেশন : অপরচুনিটিস অ্যান্ড পলিসি প্রায়রিটিস ফর বাংলাদেশ’ নামে একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ওই গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ থেকে এক হাজার ৬০০ ধরনের পণ্য বিশ্বের বিভিন্ন বাজারে রপ্তানি হয়। তৈরি পোশাকের ২৯২ ধরনের পণ্য থেকেই মোট রপ্তানি আয়ের ৮৫ শতাংশ আসে। বাকি ১৩ শতাধিক পণ্য থেকে আসে মাত্র ১৫ শতাংশ আয়। কিন্তু এই এক হাজার ৩০০ পণ্যের মধ্যে প্রচুর পণ্য রয়েছে, যেগুলোর বাজার অনেক বড় এবং প্রতিনিয়ত চাহিদা বাড়ছে। বিশেষ করে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, প্লাস্টিক পণ্য, হালকা প্রকৌশল পণ্য ও ওষুধের বাজার বড় হচ্ছে। গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নতি ও টেকসই প্রবৃদ্ধির জন্য রপ্তানি পণ্যকে বহুমুখী করতে হবে। এটি করা সম্ভব হলে একদিকে এক পণ্যের ওপর নির্ভরতা কমবে, অন্যদিকে মোট রপ্তানি আয় বাড়বে। বাড়বে কর্মসংস্থান।
কিছু অপ্রচলিত অথচ সম্ভাবনাময় রপ্তানি পণ্য নিয়ে আলোচনা করা যাক। একসময়ের ফেলে দেওয়া অনেক পণ্য থেকে রপ্তানি আয় আসতে শুরু করেছে। মাছের আঁশ, সেলুনে কাটা চুল, পরিত্যক্ত সুতা ও কাপড় এবং ছাইকে একসময় বাতিল বা ফেলে দেওয়ার জিনিস হিসেবে বিবেচনা করা হতো। এক বছর আগে প্রকাশিত একটি খবরে বলা হয়, এসব পণ্যই এখন বৈদেশিক মুদ্রা আনতে শুরু করেছে বাংলাদেশে। বিদেশের চাহিদার ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশে রীতিমতো শিল্প আকারে এসব পণ্যের সংগ্রহ, প্রক্রিয়াকরণ ও রপ্তানির ব্যবসা শুরু হয়েছে। হাজার হাজার মানুষ এসব ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে।
এখন বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর ২০০ কোটি টাকার বেশি মাছের আঁশ সাত-আটটি দেশে রপ্তানি হয়। নওগাঁ, বগুড়া ও জয়পুরহাট জেলায় বাতিল সুতার ওপর ভিত্তি করে বিশাল কুটির শিল্প তৈরি হয়েছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে ছাই রপ্তানি করেই বাংলাদেশের আয় হয়েছে তিন কোটি ২১ লাখ ৮৭ হাজার ডলারের বেশি বৈদেশিক মুদ্রা। চীন, ভারত, স্পেন, কোরিয়া, থাইল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র ও তুরস্কে এই ছাই রপ্তানি হয়। ফেলে দেওয়া চুল থেকেও প্রতিবছর শত কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা আসছে। এসব চুল দিয়ে উইগ বা পরচুলা তৈরি করা হয়। বাংলাদেশেই এখন উইগের কারখানা তৈরি হয়েছে।
বিশ্বে ধান উৎপাদনে বাংলাদেশ তৃতীয় এবং মাছ, মাংস, ডিম, শাক-সবজি উৎপাদনেও স্বয়ংসম্পূর্ণ। অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ে মাছ উৎপাদন বৃদ্ধির হারে বাংলাদেশ দ্বিতীয় স্থানে এবং ইলিশ উৎপাদনকারী ১১ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান প্রথম। কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের সৃজনশীল কৃষক পরম মমতায় মাঠে যে ফসল ফলান, তার অনেকটাই নষ্ট হয়ে যায়। অনেক সময় মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণে কৃষক উপযুক্ত মূল্য পান না।
বিশ্ববাজারে আমাদের কৃষিপণ্যের চাহিদা ও সম্ভাবনা আছে। বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের শাক-সবজি ও ফলমূলের চাহিদা রয়েছে। প্রবাসী লাখো বাংলাদেশি নিয়মিত দেশি পণ্য চান। আবার বিদেশিরাও এখানকার নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়ায় উৎপাদিত কৃষিপণ্যের প্রতি আগ্রহী। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই খাতে প্রতিবছরই বড় প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব। প্রণোদনা প্রদানসহ নানা উদ্যোগ নেওয়া হলেও কৃষিপণ্য রপ্তানিতে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনে সক্ষম হচ্ছে না বাংলাদেশ। গুণগত মানের পণ্য সংরক্ষণ ও সরবরাহ লাইনে ঘাটতিসহ সরকারের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সক্ষমতা না থাকায় রপ্তানি বাজারে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা হারাচ্ছে কৃষিপণ্য। যদি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার মাধ্যমে কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাত করা যায় এবং বিদেশে পাঠানো যায় তাহলে কৃষক ও দেশের শিল্পের জন্য ভালো হবে। এ জন্য বন্দরে পণ্য পাঠানো সহজ করতে হবে। দেশে বিশ্বমানের ল্যাব স্থাপনের পাশাপাশি রপ্তানিতে শুল্ক-অশুল্ক বাধা নিয়ে কাজ করা জরুরি। দেশে তৈরি পোশাক শিল্পের পর সবচেয়ে সম্ভাবনাময় রপ্তানি খাত হিসেবে নিঃসন্দেহে কৃষি প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্যকে এগিয়ে রাখা যায়।
চলতি বছর ৩৪টি দেশে দুই হাজার ৭০০ টন আম রপ্তানি করা হয়েছে, যা গত বছরের তুলনায় এক হাজার টন বেশি। গত বছর ২৮টি দেশে মোট এক হাজার ৭৫৭ টন আম রপ্তানি হয়েছিল। বিশ্ববাজারে দেশের আমের বিপুল চাহিদা থাকলেও উত্তম কৃষি চর্চাসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানদণ্ড মেনে আম উৎপাদন ও প্যাকেজিং না হওয়ায় রপ্তানির পরিমাণ কম মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে এখন বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে দেশে উৎপাদিত সিরামিক পণ্য। বাংলাদেশে উৎপাদিত সিরামিকের মান অত্যন্ত উন্নত হওয়ায় এবং নান্দনিক নকশার কারণে বিশ্ববাজারে এর চাহিদা ব্যাপকভাবে বাড়ছে। জাতীয় অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি অর্জনেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে সিরামিকশিল্প।
আসবাবশিল্পের বৈশ্বিক বাজারে পরিবর্তন এসেছে। পৃথিবীর বড় অনেক কম্পানি এই খাত থেকে সরে যাচ্ছে। এখন কিছু নীতিগত সুবিধা পেলে দেশের ব্যবসায়ীরা এই বাজার ধরতে পারবেন—এমনটাই আশা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের।
তৈরি পোশাক শিল্পে অতিনির্ভরতা কাটিয়ে পণ্যের বহুমুখীকরণের পাশাপাশি অর্থনীতির সার্বিক সক্ষমতা বাড়ানোর ওপর এখন জোর দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। এর পাশাপাশি বাংলাদেশ বাইরে বাজার সুবিধা টিকিয়ে রাখতে পারবে কি না; তৈরি পোশাক রপ্তানি নিয়ে কোনো উদ্বেগ দেখা দিলে করণীয় কী, তা নিয়েও এখন থেকে ভাবতে হবে। কারণ সাম্প্রতিক সময়ে দেশের পোশাক খাতের রপ্তানি ক্রয়াদেশ কমেছে ৩০ শতাংশ।
নতুন বাজারে পণ্য রপ্তানি বাড়াতে বিদেশে বাংলাদেশি দূতাবাসগুলোর বিজনেস উইংকে আরো সক্রিয় হতে হবে। বিদেশের বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের চাহিদা নিরূপণ করে জানাতে হবে। দেশি পণ্যের বাজার তৈরি করতে নিয়মিত প্রদর্শনীর আয়োজন করা যেতে পারে। এ দেশের মানুষ সৃজনশীল। ব্যবসায়ীরা নতুনত্বের প্রয়াসী। একটু সুযোগ সৃষ্টি করে দিলে অপ্রচলিত পণ্য দিয়েই বিদেশের বাজারে চমক সৃষ্টি করতে পারে বাংলাদেশ। সামান্য উদ্যোগ নতুন বাণিজ্যিক সম্ভাবনা সৃষ্টি করতে পারে।