৬ সেপ্টেম্বর। বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির প্রতিষ্ঠাতা জাতীয় অধ্যাপক মোহাম্মদ ইব্রাহিমের (১৯১১-১৯৮৯) ৩৪তম মৃত্যুবার্ষিকী। প্রতিষ্ঠাতার মৃত্যবার্ষিকীর দিনটিকে সমিতি ডায়াবেটিক সেবা দিবস হিসেবে পালন করে থাকে।
জন রাসকিন তাঁর অর্থনৈতিক দর্শনবিষয়ক প্রবন্ধের সংকলন Unto This Last (1860) বইয়ে উল্লেখ করেছেন, ‘অর্থ ও বিত্ত মানুষের সত্যিকারের মূল্যায়ন করে না, মানুষের মূল্যায়ন হয় তার ওপর অন্য মানুষের আস্থার ভিত্তিতে।
রাসকিনের ভাবদর্শনের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে তো বটেই, বিশ্বব্যাপী মহাত্মা নামে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হন এবং খ্যাতি অর্জন করেন মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী। গান্ধীজি ১৯০৮ সালে গুজরাটি ভাষায় সর্বোদয়া শিরোনামে Unto This Last-এর ভাবানুবাদ করেন।
সব ঐশী গ্রন্থ ও নীতিশাস্ত্রে অসুস্থ মানুষ বা প্রাণীকে সুস্থ করে তোলার দায়িত্ব পালনের জন্য চিকিৎসাশাস্ত্র অধ্যয়ন উদ্ভব এবং অধ্যয়ন শেষে তাঁদের একটি প্রতিজ্ঞাপত্র বা প্রত্যয় বাণী উচ্চারণ করতে হয়, যার মধ্যে সেবাকে আদর্শ হিসেবে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি রয়েছে। হিপোক্রিটাস চিকিৎসাশাস্ত্রের আদি গুরু। প্রায় পৌনে তিন হাজার বছর আগে তাঁর জন্ম। একবার শিষ্যদের গাছতলায় জড়ো করে তিনি একটি শপথবাক্য পাঠ করান। শপথবাক্যটি ছিল, ‘অতঃপর আমি শপথ গ্রহণ করছি যে জেনেশুনে এবং ধর্মত রোগীর ক্ষতি হয় এমন কোনো ওষুধ দেব না। শত্রু-মিত্রভেদে সব রোগীকে সমান মন-প্রাণ দিয়ে চিকিৎসা করব এবং তার মানসিক দুশ্চিন্তা লঘু করার জন্য সব সময় ভরসা দেব।’ হিপোক্রিটাস শপথবাক্য পাঠ করিয়েছিলেন এ জন্য যে ডাক্তার হলেও প্রত্যেকেই মানুষ এবং মানুষ মাত্রই হিংসা-দোষ আছে। এসবের বশবর্তী হয়ে চিকিৎসা করতে গেলে রোগীর জীবন বিপন্ন হতে পারে। তা যাতে না হয়, এই ছিল শপথবাক্য পাঠ করানোর মূল দর্শন। পৌনে তিন হাজার বছরে পৃথিবীর চেহারার বহু পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু শপথবাক্যটি আছে। আর আছে বলেই পৃথিবীর দেশে দেশে সার্টিফিকেট দেওয়ার সময় ডাক্তারদের ওই শপথবাক্য
(I WILL maintain the utmost respect for human life; even under threat, I will not use my medical knowledge contrary to the laws of humanity. I MAKE these promises solemnly, freely and upon my honour.) পাঠ করানো হয়।
চিকিৎসক বা চিকিৎসাকর্মী রোগীকে সেবা দেবেন সেই আদর্শ প্রত্যয় ও প্রতিশ্রুতির আলোকে। এখানে চিকিৎসক ও রোগীর সম্পর্ক হবে পারস্পরিক আস্থার ভিত্তিতে। রোগী নিশ্চয়ই প্রত্যাশা করবে চিকিৎসক তার সমস্যা মনোযোগ দিয়ে শুনবেন এবং তার রোগমুক্তির নিশানা দেবেন। সৃষ্টিকর্তা এটুকুই চান—তুমি তাকে চিকিৎসা দাও, নিরাময় আমি দেব। চিকিৎসাসেবার ভিত্তিতে রোগীকে নিরাময় দেবেন। এই বিষয়গুলো যদি আরো তাৎপর্যগতভাবে বিশ্লেষণে যাওয়া যায়, তাহলে চিকিৎসক রোগীর সম্পর্কের ধরন বা প্রকৃতি বুঝতে কারো কষ্ট হয় না। চিকিৎসক অবশ্যই সহানুভূতিপ্রবণ হবেন রোগীর সমস্যার প্রতি; কিন্তু রোগীর তরফ থেকে ডাক্তারের কাছে প্রত্যাশার বলয় ও ব্যাপ্তিকেও যদি বিবেচনায় না আনা যায়, তাহলে চিকিৎসকের সহানুভূতি-প্রবণতা যথাযথভাবে কার্যকর হবে না। অর্থাৎ রোগী ডাক্তারের কাছ থেকে কী প্রত্যাশা করছেন, সেটা চিকিৎসক যদি নিজেকে রোগীর জায়গায় কল্পনা ও উপলব্ধির জায়গায় না যান, তাহলে তাঁর পক্ষে সহানুভূতি প্রদর্শন একপেশে হয়ে দাঁড়াবে। অধ্যাপক ইব্রাহিম সহানুভূতিকে অর্থবহ বা কার্যকর করে তুলতে রোগীর জায়গায় নিজেকে অনুভব করেন। এটিই ইমপ্যাথি বা সমানুভূতি। ডায়াবেটিস চিকিৎসার একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে তাঁর গবেষণা ও চর্চার জন্য ফুটপাতে পড়ে থাকা অসহায়, হতদরিদ্র ও চিকিৎসাবঞ্চিত মানুষকে নিজের গাড়িতে তুলে নিতেন। তাঁর চিকিৎসালয়ে নিয়ে তাকে খাবার দিয়ে, ভালো পোশাক পরিয়ে, তার কাছ থেকে গবেষণার উপাদান নিয়ে পরীক্ষা করতেন। আপাত ওই ব্যক্তির থাকা-খাওয়ার সংস্থান করে তার প্রতি সহানুভূতি পোষণ করা হলো এবং তার কাছ থেকে গবেষণার উপাদান নিয়ে সেটি অনুপুঙ্খ পরীক্ষার মাধ্যমে চিকিৎসার উপায় অনুসন্ধানে ব্যাপৃত হলেন এবং সেই উপায় অন্য অনেকের সুস্থতার জন্য প্রয়োগ করলেন—এভাবে বাংলাদেশে ডায়াবেটিক চিকিৎসাব্যবস্থার গণমুখী সমানুভূতিপ্রবণ ব্যবস্থায় উন্নীত করলেন। তাঁর সেই আদর্শ, প্রয়োগ পদ্ধতির সারকথা ছিল—রোগীর সমস্যার প্রতি সমানুভূতিপ্রবণ হতে পারলে রোগীর আস্থা যেমন বাড়বে, রোগী মানসিক শান্তি পাবেন, চিকিৎসক পরোপকারের সামাজিক স্বীকৃতি পাবেন এবং এর দ্বারা সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে উভয়ের কৃতজ্ঞতা প্রকাশের উপায় ও উপলক্ষ তৈরি হবে।
লেখক : সরকারের সাবেক সচিব এবং সদস্য, ন্যাশনাল কাউন্সিল, বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি