অর্থভুবন প্রতিবেদক
৫০০ ডলারের সমপরিমাণ বাংলাদেশি টাকা বিনিয়োগ করলেই দিন শেষে কমপক্ষে দুই থেকে পাঁচ হাজার টাকা লাভ পাওয়া যাবে। অতি মুনাফার এমন প্রলোভনে পড়েই দেশের লাখ লাখ মানুষ বিনিয়োগ করেছিলেন মেটাভার্স ফরেন এক্সচেঞ্জ (এমটিএফই) নামের একটি অনলাইন প্রতিষ্ঠানে। তাদের চাতুরীতে পড়ে কয়েক লাখ মানুষ এখন নিঃস্ব। এরই মধ্যে চক্রটি বাংলাদেশিদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছে প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা। কেউ জমানো টাকা, কেউবা এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে আবার কেউ জমি বন্ধক রেখে লাখ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছিলেন এ প্রতিষ্ঠানে। এখন তারা সবাই নিঃস্ব।
প্রতারিতদের অধিকাংশই তরুণ, বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। এছাড়া শিক্ষক, চিকিৎসক, আইনজীবী এমনকি সাংবাদিকসহ অন্যান্য অনেক পেশার মানুষও রয়েছেন প্রবঞ্চিতের তালিকায়। এ প্রতারণাকাণ্ড সামনে আসার পরই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাইবার ক্রাইম ইউনিটের সদস্যরা এ নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করেছেন। তবে অনুমোদনহীন এই প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে তেমন কিছু করণীয় নেই বলে জানানো হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং অর্থপাচার ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধের দায়িত্বে নিয়োজিত দেশের কেন্দ্রীয় আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) পক্ষ থেকে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক অর্থভুবনকে বলেন, আমরা সার্কুলার জারি করে আগেই বলে দিয়েছি এগুলো অবৈধ। এ ধরনের কোনো কোম্পানি বা অ্যাপসের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিবন্ধন নেই। এরপরও যদি কেউ এসব প্রতিষ্ঠানের প্রতারণার ফাঁদে পা দেয়, তাহলে সে দায় তাকেই নিতে হবে। এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের করণীয় কিছু নেই। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অবশ্যই এ বিষয়ে তদন্ত করে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
তিনি আরও বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বিভিন্ন সময়ে গণবিজ্ঞপ্তি প্রচার ও সভা-সেমিনার করে বলা হচ্ছে, এ ধরনের অনিবন্ধিত কোম্পানি বা অ্যাপে বা ডিজিটাল ফর্মের কোনো মুদ্রায় বা অন্য কোনোভাবে বিনিয়োগ না করতে। এ ধরনের বিনিয়োগকে বেআইনি ঘোষণা করা হয়েছে। তারপরও কেউ কেউ মুনাফার প্রলোভনে এ ধরনের ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে বিনিয়োগ করছেন। ফলে একটি পর্যায়ে তারা প্রতারিত হচ্ছেন।
জানা গেছে, এমটিএফই অ্যাপসে প্রতিদিনই বিনিয়োগকৃত অর্থের বিপরীতে নির্দিষ্ট পরিমাণ লাভ পাওয়া যেত। কমপক্ষে ৫০০ ডলার বিনিয়োগ করলে দিন শেষে দুই থেকে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত লাভ আসত। আর এই মুনাফার লোভে ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলার লাখ লাখ মানুষ টাকা খাটিয়েছিলেন। অনেকে গয়না এবং মূল্যবান সামগ্রী বন্ধক রেখেও বিনিয়োগ করেছিলেন। এর মধ্যে নওগাঁ, চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ উত্তরাঞ্চলের মানুষ বেশি। জেলাগুলোতে এমটিএফই অ্যাপের কয়েকজন করে সিও পদধারীও কাজ করতেন। গত শুক্রবার মধ্যরাত থেকেই পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায় অ্যাপসটি। শনিবার সকাল থেকে ওয়েবসাইটটিও বন্ধ হয়ে যায়। বাংলাদেশে এ ধরনের অ্যাপ চালানোর ক্ষেত্রে সরকারের কোনো সংস্থার অনুমোদন ছিল না। যদিও অনুমোদনহীন এই অ্যাপসে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে মোবাইল ব্যাংকিংসহ বিভিন্ন ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করা হয়েছে।
কেন প্রশাসনের দৃষ্টিগোচর হলো না?
২০২১ সালের পর থেকে এমটিএফই বাংলাদেশে ভার্চুয়ালি কার্যক্রম চালালেও তা কেন প্রশাসনের নজরে এলো না, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। এছাড়া এই অ্যাপসের বিনিয়োগের পুরো টাকাই বিদেশে পাচার হয়ে গেছে।
বিএফআইইউ প্রধান মো. মাসুদ বিশ্বাস অর্থভুবনকে বলেন, এমটিএফই একটি অনিবন্ধিত ও অনুমোদনহীন অনলাইন প্রতিষ্ঠান। এটি আমাদের কোনো রিপোর্টিং সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান নয়। এছাড়া এটি যে দেশের প্রতিষ্ঠান সেই দেশও ডিসক্লোজার দিয়েছে যে, এটি এ ধরনের ট্রেডিং করার জন্য নিবন্ধনপ্রাপ্ত না। তাই এ বিষয়ে বিএফআইইউর করণীয় কিছু নেই। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে আমাদের কাছে কোনো তথ্য চাওয়া হলে সেটি দিয়ে অবশ্যই সহযোগিতা করা হবে।
জানা গেছে, মাল্টিলেভেল মার্কেটিং বা এমএলএম পঞ্জি মডেলে ব্যবসা করা এমটিএফই দুবাই (সংযুক্ত আরব আমিরাত) ও কানাডাভিত্তিক প্রতিষ্ঠান। তবে দুবাইয়ে প্রতিষ্ঠানটির সদর দপ্তর। বাংলাদেশ ছাড়া বিশ্বের আরও কয়েকটি দেশে তাদের নেটওয়ার্ক। কোম্পানিটি এমএলএম ব্যবসার ছদ্মবেশে অনলাইন গ্যাম্বলিং ও ক্রিপ্টো ট্রেডিং করত। ফোরেক্সও হতো এখানে। এটির ওয়েবসাইট ও অ্যাপস ছিল। লেনদেনও হতো ওয়েবসাইট বা অ্যাপেই। এই ব্যবসায় জড়িত প্রতারক চক্র বিভিন্ন নামি-দামি হোটেলে মিটিং করে বিনিয়োগকারী ধরার ফাঁদ পাততো। স্বল্প বিনিয়োগে রাতারাতি কোটিপতি হওয়ার স্বপ্ন দেখাত তারা। আর এই ফাঁদে পড়েই এমটিএফইতে শুধু বাংলাদেশ থেকেই কয়েক লাখ মানুষ যুক্ত হয়েছিলেন। এর মধ্যে কেউ কেউ ৫ হাজার ডলারের বেশি বিনিয়োগ করেছেন। এভাবে কোম্পানিটি গ্রাহকদের কাছ থেকে প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।
মো. হুমায়ুন নামের এক ভুক্তভোগী বলেন, আমরা এই অ্যাপ সম্পর্কে কিছুই জানতাম না। টিম লিডারদের কথা শুনে বিনিয়োগ করেছিলাম। ১ লাখ টাকা বিনিয়োগ করার পর বেশ কিছুদিন লাভ তুলেছিলাম। এরপর ব্যালেন্স শূন্য হয়ে যায়। তিনি অ্যাপের সঙ্গে জড়িত প্রতারক চক্রকে আইনের আওতায় আনার জোর দাবি জানান।
রাজু আহমেদ নামে আরেক ভুক্তভোগী বলেন, চলতি বছরের শুরুতে এই অ্যাপের সঙ্গে পরিচিত হই। প্রথমে কিছু টাকা লাভ হয়েছিল। এরপর ৫ লাখ টাকার মতো বিনিয়োগ করি। কিন্তু এখন পুরো টাকাই আটকে গেছে।