অর্থভুবন ডেস্ক
মানুষ এমন কিছু পাপ ও অপরাধে জড়িয়ে পড়ে, যাতে দেহ থেকে প্রাণ বের না হলেও গোপনে মেরে ফেলে আত্মাকে। মনে-কর্মে অবসাদ নিয়ে আসে। সবকিছুতে শূন্যতা ও একাকিত্ব অনুভব হয়। নেক আমলের নূর চলে যায়। অন্ধকার স্থান করে নেয় অন্তরে। কোনো কিছুতেই ভালো লাগে না। ইবাদতে স্বাদ মেলে না। কর্মে তৎপরতা ও চাঞ্চল্য থাকে না।
আল্লাহ থেকে অনেক দূরে সরিয়ে নিয়ে যায়। ঈমানে দুর্বলতা চলে আসে। এমনকি জাহান্নামে যাওয়ারও কারণ হতে পারে। এমন কিছু গুনাহর চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করছি :
গোপন অপরাধ ও পাপ : গোপন ইবাদত যেমন আল্লাহর কাছে অধিক পছন্দনীয়, তেমনি গোপন অপরাধগুলোও আল্লাহর অসন্তুষ্টির কারণ। গোপনে কারও হক নষ্ট করা, কাউকে কষ্ট দেওয়া, গোপনে হারাম কাজে লিপ্ত হওয়া সবই গোপন অপরাধের অন্তর্ভুক্ত। বান্দা গোপনে গুনাহ করতে করতে অন্তর কলুষিত করে ফেলে। ফলে আল্লাহর রহমত থেকে দূরে সরে যায়। হাদিসে এসেছে, ‘বান্দা যখন একটি গুনাহ করে তখন তার অন্তরে একটি কালো চিহ্ন পড়ে। অতঃপর সে যখন গুনাহের কাজ পরিহার করে, ক্ষমাপ্রার্থনা করে এবং তওবা করে, তার অন্তর তখন পরিষ্কার ও দাগমুক্ত হয়ে যায়। সে আবার পাপ করলে তার অন্তরে দাগ বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং তার পুরো অন্তর এভাবে কালো দাগে ঢেকে যায়। এটাই সেই মরিচা আল্লাহ তায়ালা যার বর্ণনা করেছেন, ‘কখনো নয়, বরং তাদের কৃতকর্মই তাদের মনে মরিচা ধরিয়েছে’ (সুরা মুতাফফিফিন : ১৪; তিরমিজি : ৩৩৩৪)। গোপন গুনাহের পরিণতি সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, আমি আমার উম্মতের কতক দল সম্পর্কে অবশ্যই জানি, যারা কেয়ামতের দিন তিহামার শুভ্র পর্বতমালা সমতুল্য নেক আমল নিয়ে উপস্থিত হবে, কিন্তু মহামহিম আল্লাহ সেগুলোকে বিক্ষিপ্ত ধূলিকণায় পরিণত করবেন। সাওবান (রা.) বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! তাদের পরিচয় পরিষ্কারভাবে আমাদের কাছে বর্ণনা করুন, যাতে অজ্ঞাতসারে আমরা তাদের অন্তর্ভুক্ত না হয়ে যাই। তিনি বললেন, ‘তারা তোমাদেরই ভ্রাতৃগোষ্ঠী এবং তোমাদের সম্প্রদায়ভুক্ত। তারা রাতের বেলা তোমাদের মতোই ইবাদত করবে। কিন্তু তারা এমন লোক, যারা একান্ত গোপনে আল্লাহর হারাম কর্মে লিপ্ত হবে।’ (ইবনে মাজা : ২/১৪১৮)
দৃষ্টি সংযত না রাখা : অন্তরের নূর চলে যাওয়ার একটি কারণ হলো দৃষ্টি অবনত না করা। বেগানা নারীর প্রতি দৃষ্টিপাত করলে শয়তান অন্তরে কুমন্ত্রণা সৃষ্টি করে। ধীরে ধীরে বড় গুনাহের দিকে যায়। এমনকি জিনা-ব্যভিচারের প্রতি প্রলুব্ধ করতে থাকে। এ জন্যই নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘অনিয়ন্ত্রিত দৃষ্টি হচ্ছে শয়তানের বিষাক্ত তীরগুলো থেকে একটি তীর’ (মুসনাদে শিহাব ১/১৯৫)। এই তীরে বিদ্ধ হওয়া থেকে বাঁচতে হলে নজর হেফাজত করতে হবে। অন্যথায় অগণিত নেক-আমল করা সত্ত্বেও আল্লাহর সান্নিধ্য থেকে বঞ্চিত হতে হবে। ইবনে কাসির (রহ.) বলেন, ‘নজর এমন একটি তীর যা মানুষের অন্তরে বিষের উদ্রেক করে’ (তাফসিরে ইবনে কাসির : ৩/১৭৬)। তাই রাসুল (সা.) উম্মতকে নির্দেশ দিয়ে বলেন, ‘তোমরা দৃষ্টিকে নত করো, নিয়ন্ত্রণ করো এবং লজ্জাস্থান হেফাজত করো।’ (তবারানি : ৮০১৮)
পর্নোগ্রাফির আসক্তি : এটিও গোপন গুনাহের একটি প্রকার। চোখের খেয়ানতই হলো এই আসক্তির মূল কারণ। আত্মাকে গলা টিপে হত্যা করে ফেলে এটি। লাখ লাখ তরুণ-তরুণী এর ভয়াল থাবায় আক্রান্ত। অনেকে চেষ্টা করেও বের হতে পারছে না। মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়েছে এটি গ্রামগঞ্জেও। এর প্রতিক্রিয়া এতটাই ভয়াবহ যে, দাম্পত্য জীবন নষ্ট করার পেছনেও এর প্রভাব বিদ্যমান। বিয়ের পরও অনেকে এর আসক্তি থেকে বের হতে পারছে না। ভেবে দেখেছেন, এই পর্নোগ্রাফি কতটা ভয়ংকর রূপ ধারণ করেছে? অনেকে অজান্তেই নিজেকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমরা নিজেদের ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিও না’ (সুরা বাকারা : ১৯৫)। সমাজে অধিকহারে ধর্ষণের জন্য এই পর্নোগ্রাফি দায়ী। অনেক সাধারণ দীনদার লোকও সব গুনাহ ছাড়লেও এখান থেকে বের হতে পারছে না। গোপন গুনাহে জর্জরিত তারা। হায়া-শরম সব বরবাদ করে গোপনে চোখের জিনায় লিপ্ত। হাদিসে এসেছে, ‘নিঃসন্দেহে চোখের ব্যভিচার হলো দৃষ্টিপাত, কানের ব্যভিচার হলো শোনা, জিহ্বার
ব্যভিচার হলো কথোপকথন করা, হাতের ব্যভিচার হলো শক্ত করে ধরা, পায়ের ব্যভিচার হলো হেঁটে যাওয়া এবং হৃদয়ের ব্যভিচার হচ্ছে কামনা-বাসনা করা। আর লজ্জাস্থান তা বাস্তবায়ন করে বা মিথ্যা সাব্যস্ত করে। (মুসলিম : ৬৬৪৭)
মুক্তিলাভের উপায় : গোপন গুনাহ থেকে কীভাবে মুক্তি পেতে হয় তার কৌশল নিজেকেই আয়ত্ত করে নিতে হবে। কারও হিম্মতই পারে তাকে এখান থেকে বের করতে। একটু সৎ সাহস ও ইচ্ছা থাকলেই আল্লাহ তায়ালা উপায় বের করে দিবেন। এ ছাড়া কিছু বিষয় মেনে চলা অপরিহার্য। একাকী থাকা যাবে না। অলস সময় পার না করে যেকোনো ভালো কাজে নিয়োজিত থাকতে হবে। কথায় আছে, ‘অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা।’ ইন্টারনেট ব্যবহারে সতর্ক থাকা চাই। পর্নোগ্রাফির বিরুদ্ধে নিজেই প্রকাশ্যে প্রচার চালাতে হবে। লজ্জা-শরম তো ঈমানের অঙ্গ (বুখারি : ৪০)। লজ্জাশীলতা বাড়াতে হবে। সৎ ও নেককার বন্ধুদের সঙ্গে চলতে হবে। হক্কানী আলেমদের সংস্রবে আসতে হবে। সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস, অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ। মনে রাখতে হবে, এ ক্ষেত্রে বিয়ের কোনো বিকল্প নেই। আল্লাহ তায়ালা বোঝার ও আমল করার তওফিক দান করুন।
পরিচালক, দারুস সুন্নাহ মডেল মাদরাসা,
খিলক্ষেত, ঢাকা