অর্থভুবন ডেস্ক
বাংলাদেশ ও ফ্রান্সের মধ্যে নতুন কৌশলগত অগ্রযাত্রা আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় কার্যকর ভূমিকা রাখবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁর সঙ্গে আমার ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ফ্রান্স সরকার বাংলাদেশের জনগণের মৌলিক অধিকার ও মানবাধিকার সুরক্ষায় সরকারের কর্মকান্ডে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছে।
চলমান ভূরাজনৈতিক অস্থিরতা ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যেও ফ্রান্স বাংলাদেশের নীতি প্রণয়নের সার্বভৌমত্বকে সম্মান ও সমর্থন জানিয়েছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
গতকাল সোমবার ফরাসি প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বৈঠকের পর যৌথ সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী। সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনার বক্তব্যের সময় ফরাসি প্রেসিডেন্ট তার প্রতি সমর্থন জানান।
এর আগে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ইমানুয়েল মাখোঁ এবং শেখ হাসিনার মধ্যে দ্বিপক্ষীয় এবং একান্ত বৈঠক হয়। ঢাকা ও প্যারিস বঙ্গবন্ধু-২ স্যাটেলাইট ও বাংলাদেশের নগর অবকাঠামো উন্নয়ন বিষয়ে দুটি চুক্তি সই করে।
দুই নেতার বৈঠকের পর ‘বাংলাদেশ-ফ্রান্স যৌথ বিবৃতি : শান্তি, সমৃদ্ধি ও মানুষের জন্য অংশীদার’ ঘোষণা করা হয়। এতে বলা হয়, ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশ হওয়ার জন্য কৌশলগত অংশীদার প্রয়োজন বাংলাদেশের এবং সেই লক্ষ্য অর্জনে সহায়তা করতে আগ্রহী ফ্রান্স। অন্যদিকে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে নিজেদের প্রভাব-বলয় বাড়ানোর অংশ হিসেবে নতুন অংশীদার প্রয়োজন প্যারিসের, তাই অন্য আরও অনেক দেশের পাশাপাশি বাংলাদেশকেও বেছে নিয়েছে ফ্রান্স। এ কারণে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করার পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ ও কৌশলগত খাতে সহযোগিতা বাড়াতে রাজি দুই দেশ। শান্তি, সমৃদ্ধি ও জনগণের জন্য উভয় দেশের অংশীদারত্বকে কৌশলগত স্তরে নেওয়ার জন্য দুই দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব কাজ করবে বলে সম্মত হয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ইমানুয়েল মাখেঁাঁ।
যৌথ সংবাদ সম্মেলনে ফরাসি প্রেসিডেন্টের নেতৃত্বে বাংলাদেশ সফররত ফ্রান্স প্রতিনিধিদলের সদস্যদের শুভেচ্ছা জানান প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ ও ফ্রান্সের মধ্যে পাঁচ দশকের বেশি সময়ের সম্পর্কে আজ একটি ঐতিহাসিক দিন। আমার বাবা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালে যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের সূচনা করেছিলেন আজ তা নতুন মাত্রায় উন্নীত হয়েছে। অত্যন্ত সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে প্রেসিডেন্ট মাখোঁর সঙ্গে আমার সার্বিক বিষয়ে ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে। চলমান ভূরাজনৈতিক অস্থিরতা ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার প্রেক্ষাপটে ফ্রান্স বাংলাদেশের নীতি প্রণয়নের সার্বভৌমত্বকে সম্মান ও সমর্থন জানিয়েছে। বাংলাদেশ ও ফ্রান্সের এ নতুন কৌশলগত অগ্রযাত্রা আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় কার্যকর ভূমিকা রাখবে বলে আমরা উভয়ই আশাবাদী।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘দেড় দশক ধরে বাংলাদেশে চলমান সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা, উন্নয়ন ও সুশাসন এ নতুন সম্পর্কের মূল ভিত্তি। ফ্রান্স সরকার বাংলাদেশের জনগণের মৌলিক অধিকার ও মানবাধিকার সুরক্ষায় সরকারের কর্মকান্ডে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছে।’
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের অর্থনীতির অভাবনীয় ও ধারাবাহিক অগ্রযাত্রায় ফ্রান্স সরকারের আস্থার কথা দৃঢ়তার সঙ্গে উদ্ধৃত হয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক সুবিধা অব্যাহত রাখার মাধ্যমে রূপকল্প-২০৪১ বাস্তবায়নে বাংলাদেশের জনগণ ও সরকারের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছে। এজন্য আমি প্রেসিডেন্ট মাখোঁর নেতৃত্বাধীন ফ্রান্স সরকারকে ও ফ্রান্সের জনগণকে বাংলাদেশের জনগণের পক্ষ থেকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি।’
সরকারপ্রধান বলেন, ‘প্রেসিডেন্ট মাখোঁর এ সফরে দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। আমরা কিছু সমঝোতায় উপনীত হতে সক্ষম হয়েছি। বাংলাদেশের বিশস্ত উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে ফ্রান্স আমাদের অবকাঠামোগত উন্নয়নে সহযোগিতা অব্যাহত রাখার বিষয়ে নিশ্চিত করেছে। পাশাপাশি বাংলাদেশের কৌশলগত সুরক্ষা অবকাঠামো বিনির্মাণে উন্নত ও বিশেষায়িত কারিগরি সহায়তা দিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ভূরাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ ও ফ্রান্স নেতৃস্থানীয় ও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করবে।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব মোকাবিলায় ফ্রান্সের অগ্রণী ভূমিকাকে আমরা স্বাগত জানাই। এ লক্ষ্যে প্রেসিডেন্ট মাখোঁর নেতৃত্বে একটি টেকসই তহবিল গঠনে ফ্রান্সের আহ্বানকে আমরা সাধুবাদ জানিয়েছি। ফ্রান্সের সঙ্গে শিক্ষা, সংস্কৃতি ও ভাষা বিনিময়ের বিষয়েও ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে।’
ঢাকা-প্যারিস দুই চুক্তি স্বাক্ষর : দুটি চুক্তির একটি হলো ‘ইমপ্রুভিং আরবান গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ইনফ্রাস্ট্রাকচার প্রোগ্রাম’ বিষয়ে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) ও ফ্রান্সের ফ্রান্স ডেভেলপমেন্ট সংস্থার (এএফডি) মধ্যে ক্রেডিট ফ্যাসিলিটি অ্যাগ্রিমেন্ট এবং আরেকটি হলো বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেড (বিএসসিএল) ও বঙ্গবন্ধু-২ আর্থ অবজারভেশন স্যাটেলাইট সিস্টেম সম্পর্কিত ফ্রান্সের এয়ারবাস ডিফেন্স অ্যান্ড স্পেস এসএএসের মধ্যে সহযোগিতার বিষয়ে লেটার অব ইনটেন্ট (এলওআই) চুক্তি।
ইআরডি সচিব শরিফা খান ও এজেন্স ফ্রান্সেইস দো ডেভেলপমেন্টের (এএফডি) কান্ট্রি ডিরেক্টর বোনুই শসেত নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের পক্ষে প্রথম চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। দ্বিতীয় চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন বিএসসিএল চেয়ারম্যান ড. শাহজাহান মাহমুদ ও স্পেস সিস্টেম, এয়ারবাসের সেলস ও মার্কেটিং বিভাগের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট স্টিফেন ভেসভাল।
আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থার এক প্রতিবেদনের খবর অনুযায়ী, বাংলাদেশে সফররত ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ সোমবার বলেছেন, ফরাসি উড়োজাহাজ নির্মাণ সংস্থার তৈরি নতুন ১০টি এয়ারবাস কেনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ঢাকা। বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক শেষে বিবৃতিতে মাখোঁ বলেছেন, “ইউরোপীয় মহাকাশ শিল্পে আস্থা রাখার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। ‘এ ৩৫০’ মডেলের ১০টি এয়ারবাসের জন্য প্রতিশ্রুতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।”
ফরাসি কর্মকর্তারা জানান, ‘এ ৩৫০’ মডেলের সুপরিসর উড়োজাহাজের জন্য চুক্তি চূড়ান্ত হচ্ছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস লিমিটেডের সঙ্গে। এয়ারবাস কিনতে আগ্রহী বাংলাদেশ সরকার।
অংশীদার হিসেবে পরস্পরকে পাশে চায় ঢাকা-প্যারিস : যৌথ বিবৃতিতে রাজনৈতিক সম্পর্ক দৃঢ়করণ, ব্যবসা-বাণিজ্য বৃদ্ধি, রোহিঙ্গা ইস্যুতে সহায়তা, সামরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি, জলবায়ু পরিবর্তনে সহায়তা, ইউক্রেন যুদ্ধসহ বিভিন্ন বিষয়ে দুপক্ষের সহযোগিতা ও অবস্থান তুলে ধরা হয়েছে। এ ছাড়া বাংলাদেশকে ২০ কোটি ডলার সহায়তা এবং এয়ারবাস কোম্পানি থেকে একটি স্যাটেলাইট ক্রয়সংক্রান্ত দুটি চুক্তি হয়েছে। এয়ারবাস থেকে ১০টি বিমান ক্রয়ের বিষয়ে বাংলাদেশের প্রতিশ্রুতিরও উল্লেখ আছে বিবৃতিতে।
পাঁচ পাতার যৌথ বিবৃতিতে তিন বড় ক্ষেত্রে দুই দেশের অংশীদারত্বের বিভিন্ন বিষয়গুলো বলা হয়েছে। এর মধ্যে প্রথম ক্ষেত্র হচ্ছে সহনশীলতা ও সমৃদ্ধির জন্য অংশীদারত্ব, দ্বিতীয় হচ্ছে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া, শান্তি ও নিরাপত্তার অংশীদারত্ব এবং তৃতীয় ক্ষেত্র হচ্ছে মানুষে-মানুষে যোগাযোগে অংশীদারত্ব।
জলবায়ু পরিবর্তন : জলবায়ু পরিবর্তন বাংলাদেশের অস্তিত্বের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি। উন্নত বিশ্বের ভুলের খেসারত দিতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগ মোকাবিলায় বাংলাদেশের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য সহায়তা করবে ফ্রান্স।
যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তন তহবিল থেকে উন্নয়নশীল দেশগুলো যেন দ্রুত অর্থ পায়, সেটির প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করা উচিত বলে মনে করে ঢাকা ও প্যারিস।
অর্থনৈতিক সহযোগিতা : দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বৃদ্ধিতে উভয় দেশ সম্মত হয়েছে। বাংলাদেশের অবকাঠামো, বিশেষ করে রেলওয়েতে সম্ভাব্য বিনিয়োগ খুঁজে বের করার বিষয়ে একমত হয়েছে দুই দেশ। আগামী ২৩ থেকে ২৫ অক্টোবর ফ্রান্সের প্যারিস ও তুলোতে বাংলাদেশ বিনিয়োগ সম্মেলনেরও সাফল্য কামনা করা হয়েছে বিবৃতিতে।
ইউক্রেন যুদ্ধ : আন্তর্জাতিক আইন বিশেষ করে জাতিসংঘ চার্টার লঙ্ঘন হচ্ছে ইউক্রেন যুদ্ধে, এ অভিমত প্রকাশ করেছে উভয় দেশ। যুদ্ধের পরিণতির কারণে উদ্বেগ প্রকাশ করে বিবৃতিতে বলা হয়, ওইসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় উভয় দেশ তৈরি।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে, বিশেষ করে আফ্রিকায় শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে বাংলাদেশে ভূমিকার প্রশংসা করেছে ফ্রান্স এবং শান্তিরক্ষা মিশনে সহায়তা করার বিষয়ে উভয় দেশ রাজি হয়েছে।
বিভিন্ন দেশে বেআইনিভাবে সামরিক সরকারের ক্ষমতা দখলকে নিন্দা জানানো হয়েছে বিবৃতিতে। পাশাপাশি সংঘাত, সহিংসতা ও নৃশংসতার জন্য বাস্তুচ্যুতদের নিরবচ্ছিন্ন মানবিক সহায়তা অব্যাহত রাখার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।
রোহিঙ্গাদের সহায়তার জন্য ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসে গাম্বিয়া বনাম মিয়ানমার মামলায় এখন থেকে সরাসরি কাজ করবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে ফ্রান্স।
সামরিক সহযোগিতা : ২০২১ সালে দুই দেশ সামরিক সহযোগিতা বৃদ্ধির জন্য একটি লেটার অব ইনটেন্ট সই করেছিল। ওই সমঝোতার আলোকে বাংলাদেশের নৌ, বিমান ও টেরেস্ট্রিয়াল সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য সহযোগিতা বাড়াতে চায় ফ্রান্স। এ ছাড়া অপ্রথাগত নিরাপত্তা ঝুঁকি, যেমনÑ সমুদ্র নিরাপত্তা ও অন্যান্য বিষয়েও দুই দেশের সহযোগিতার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে।