অর্থভুবন ডেস্ক
এক সময় যাতায়াতের সহজলভ্যতা আর বুড়িগঙ্গার রূপে মুগ্ধ হয়ে নদীতীরবর্তী এলাকাগুলোতে ঘাঁটি গেড়েছিলেন ইংরেজরা। কালের স্রোতে তারা হারিয়েও গেছেন। মানুষ তাদের কথা মনে না রাখলেও ঢাকা শহরের আনাচে-কানাচে থেকে গেছে তাদের নাম। মানুষের মুখে মুখে তা ছড়িয়েছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। এ যেন একরকম হারিয়ে গিয়েও থেকে যাওয়া। তেমনই এক ইংরেজ সাহেবের স্মৃতি বিজড়িত স্থান পুরান ঢাকার ওয়াইজঘাট।
রাজধানীর সদরঘাট মোড় থেকে পাটুয়াটুলী হয়ে ইসলামপুরের দিকে এগিয়ে গেলে অধুনালুপ্ত মুন-স্টার হলের সামনে দিয়ে বুড়িগঙ্গার পাড়ে যেখানে রাস্তা শেষ, সেটিই ওয়াইজঘাট। বুড়িগঙ্গাতীরের বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘাট এটি। জানা যায়, ওয়াইজ নামে এক সাহেবের নামানুসারেই এই ঘাটের নামকরণ করা হয়েছিল। তবে ঠিক কোন ওয়াইজ সাহেবের নামে নামকরণ করা হয়েছে, তা নিয়ে ইতিহাসবিদদের মতানৈক্য রয়েছে। কেননা, উনিশ শতকের ষাটের দশকে ঢাকা শহরে মোট তিনজন ওয়াইজ সাহেব বাস করতেন। যাদের একজন ছিলেন ঢাকার তৎকালীন সিভিল সার্জন ও লেখক ডা. জেমস ওয়াইজ। একজন ছিলেন ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ এবং শেষজন ছিলেন কুখ্যাত এক নীলকর।
পুরান ঢাকার স্থানীয়দের কাছ থেকে জানা যায়, এক সময় পুরান ঢাকার শ্যামবাজার থেকে সোয়ারিঘাট পর্যন্ত পুরো এলাকাটি দিনের বেলায় থাকত জমজমাট। তবে রাতে নেমে আসত সুনসান নীরবতা। ব্যতিক্রম ছিল ওয়াইজঘাট। সেই সময় দুটি সিনেমা হল ছিল এ এলাকায়। ফলে গভীর রাত পর্যন্ত সরব থাকত ওয়াইজঘাট। সোনার দোকানের কারিগর, বাদামতলীর ফল ব্যবসায়ী, কার্গো কোম্পানিগুলোর দালাল, ডকইয়ার্ডের শ্রমিক আর দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা বেপারিদের হই-হুল্লোড়ে সরগরম হয়ে থাকত পুরো এলাকা।
অধ্যাপক ড. মুনতাসীর মামুনের লেখা ‘ঢাকা : স্মৃতি বিস্মৃতির নগরী’ গ্রন্থ থেকে জানা যায়, নীলকর ওয়াইজের নামে বুড়িগঙ্গাতীরের এই ঘাটের নাম হয় ওয়াইজঘাট। ১৭৭৭ সালে বাংলায় তথা ঢাকায় প্রথম নীল চাষ শুরু হয়। ঢাকার নীলক্ষেত এলাকার বিরাট প্রান্তরজুড়ে নীল চাষ করা হতো। ১৮৩০ সালে সরকারিভাবে আইন জারি করে ঢাকার কৃষকদের নীল চাষে বাধ্য করা হয়। ১৮৪৭ সালের দিকে ঢাকায় ৩৭টি নীলকুঠি ছিল। সবচেয়ে নামকরা নীলকর ছিলেন ওয়াইজ। তৎকালীন ব্রিটিশ প্রশাসনে নীলকর ওয়াইজের প্রভাব ছিল ব্যাপক। নীল চাষের মাধ্যমে একজন সাধারণ ব্যবসায়ী থেকে ধনাঢ্য বণিকে পরিণত হন ওয়াইজ। তার প্রভাব এত বেশি ছিল যে, সাধারণ জনগণ তাকেই সরকার বাহাদুর মনে করত। এই ওয়াইজের পৃষ্ঠপোষকতায় সেই সময় ‘ঢাকা নিউজ’ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা বের করা হতো। পত্রিকাটি ইংরেজ সরকারের মুখপত্র হিসেবে কাজ করত।
প্রায় একই তথ্য পাওয়া যায় ইতিহাসবিদ শরীফ আহমেদ সম্পদিত ‘ঢাকা কোষ’ গ্রন্থে। গ্রন্থটি থেকে জানা যায়, নীলকর ওয়াইজের বাড়ির পাশে নদীর ঘাটে বড় নৌকা ও বজরা বাঁধা থাকত বলে এক সময় এটি ওয়াইজঘাট নামে পরিচিতি পায়। ১৮৫১ সালে নীলকর ওয়াইজ ভাওয়াল রাজা কালী নারায়ণের কাছে তার জমিদারি বিক্রি করে ইংল্যান্ডে চলে যান। এরপর থেকে তার বাড়ির পাশের ঘাটটি এখনো ওয়াইজঘাট নামেই রয়ে গেছে। তবে নাজির হোসেনের লেখা ‘কিংবদন্তির ঢাকা’ গ্রন্থে সিভিল সার্জন ডা. জেমস ওয়াইজ সাহেবের নামেই ওয়াইজঘাটের নামকরণ করা হয় বলে উল্লেখ রয়েছে।
ওয়াইজঘাটের নাম যার নামেই নামকরণ করা হোক না কেন, এক সময়কার প্রতাপশালী নীলকর কিংবা মানবিক সিভিল সার্জন, কাউকেই সেভাবে মনে রাখেনি বর্তমান প্রজন্ম। শুধু মানুষের মুখে মুখে থেকে গেছে তাদের নাম। ‘ঢাকা কোষ’ গ্রন্থে উল্লেখ পাওয়া যায় নীলকর ওয়াইজের পাশাপাশি দুটি বাড়ির কথা। যার একটিতে বর্তমান বুলবুল ললিতকলা একাডেমির কার্যক্রম চলছে। এ ছাড়া কোথাও নেই তাদের কোনো স্মৃতি। কালের স্রোতে ভেসে গিয়েও তারা থেকে গেছেন মানুষের মুখে মুখে।