Friday, November 8, 2024

সবুজ শহর আকসুতেই পড়ে থাকে মন

অর্থভুবন ডেস্ক

বিশাল জায়গাজুড়ে পার্ক। এই পার্ক পায়ে হেঁটে অতিক্রম করা কঠিন। অ্যাডর্নের সৈয়দ জাকির হোসাইনকে বললাম, ‘এত বড় পার্ক হেঁটে পরিভ্রমণ আমার পক্ষে অসম্ভব। বিকল্প ব্যবস্থা হলে আমাকে নিয়ে যাবেন।’ ভ্রমণক্লান্তি, লাঞ্চের পর সবার মধ্যে একটু ঝিমানো চলে এসেছে। আকবর ভাইকে জানানোর পর সিদ্ধান্ত হয়- পার্কের চাকাওয়ালা ট্রেনে করে তাও লাং নৃগোষ্ঠীর আরেক কালচারাল সেন্টারে নেওয়া হবে সবাইকে। তাদের নৃত্য-গীতে অংশ নিতে হবে।
 
ট্রেনে ওঠার পর বুঝতে পারলাম এই বিরাট পার্কে এ রকম ট্রেন পরিব্রাজকদের জন্য বাড়তি পাওনা। তা না হলে অনেক পথ হেঁটে সাংস্কৃতিক কেন্দ্র যেতে হতো। ট্রেনে করে দলের সবাই দেখছে শত শত বছরের গাছগুলো ভাস্কর্য বানিয়ে পার্কে স্থাপন করা হয়েছে। মনে হলো পৃথিবীর অন্য জগতে প্রবেশ করেছি। দুচোখ লেগে থাকল শিল্পকলার প্রতি কী গভীর অনুরাগ পোষণ করে এই নৃগোষ্ঠী!
কালচারাল সেন্টারে আধঘণ্টাব্যাপী একদল বাদক ও নৃত্যশিল্পী আমাদের অন্য জগতে নিয়ে গিয়েছিল। এই নৃত্য-গীত শেষ হতেই স্থানীয় শিল্পীরা আমাদের অভিবাদন জানায়। সবাই সেন্টারের বাইরে জমায়েত হয়ে গল্পে মেতে উঠেছে।
 
স্বর্ণা বলল, ‘কেমন লাগল তাও লাংদের এই পরিবেশনা।’
 
‘শুধু যে মুগ্ধ হয়েছি তা নয়। পুলকিত হয়েছি। বিচিত্র নৃগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক বন্ধন লক্ষ করেছি। আর এসব কলাকুশলীদের আমার আপনজন ভাবতে ভালো লাগছে।’
প্রায় আধঘণ্টা স্বর্ণা এবং চায়না মিডিয়ার বেইজিং থেকে আগত রিপোর্টার মিয়াং মিডিয়ার জন্য আমার একটি সাক্ষাৎকার গ্রহণ করে। কালচারাল সেন্টার থেকে বের হতেই আকবর ভাই বলল, ‘তাড়াতাড়ি গাড়িতে উঠুন, আকসুতে এক স্কুল পরিদর্শনে যেতে হবে। ওরা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।’
গাড়িতে উঠেই আনন্দীকে বললাম, ‘ইটস এ ট্রিমেন্ডার্স বিউটি। অনেক দিন মনে রাখব।’
 
তাও লাং নদী, বিচিত্র বনভূমি পেছনে ফেলে এক জায়গায় গাড়ি থেমে যায়। হাইওয়ের ত্রিমুখে বিশাল এক মনুমেন্টের পাশে দাঁড়িয়ে দেখতে থাকি তাও লাং নৃগোষ্ঠীর কীর্তিমান নারী-পুরুষের টেরাকোটায় তৈরি নিপুণ কারুকাজ খচিত চিত্রকলা। পাশে তুলা ক্ষেতের অপূর্ব বিন্যাস। ফসল উৎপাদন যেন চীনারা শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছে।
 
আরটিভির বেলায়েত ভাইকে বললাম, ‘এমন একটি সৃষ্টিশীল জাতির কাছ থেকে কিছু ঋণ নিয়ে গেলাম। মানবিক চিরায়ত ভালোবাসার ঋণ। ভূখণ্ড নয়। হাজার বছরের সংস্কৃতি পরস্পর আত্মায় প্রোথিত। আমরা সেখানেই মানুষের সৌহার্দের সুশীতল ছায়ায় আবগাহন করলাম। স্যালুট, প্রিয় তাও লাংয়ের মানুষদের।
 
এখন সূর্যের অন্তিমকাল। হেলে পড়েছে গাছ-গাছালির আড়ালে। স্থানীয় সময় আমাদের চেয়ে দুই ঘণ্টা এগিয়ে। পাশ দিয়ে তাও লাং নদী বয়ে যাচ্ছে। বনভূমি পেরিয়ে আকসুর উইঘুর স্কুলে পৌঁছাতে ৫টা বেজে যায়। স্কুলের গেটে গাড়ি থামতেই প্রিন্সিপাল তার শিক্ষকদের নিয়ে আমাদের অভ্যর্থনার জন্য এগিয়ে আসে। বিশাল স্কুল। স্কুলটিতে ৯ বছর বয়সি শিশু থেকে ক্লাস নাইন পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দেওয়া হয়। এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ২ হাজার শিক্ষার্থী পড়াশোনা করে। তন্মধ্যে ১ হাজার ৮০০ উইঘুর মুসলিম শিক্ষার্থী; বাকিরা হান, কাজাখ এবং অন্যান্য নৃগোষ্ঠীর শিক্ষার্থী।
 
২০০৩ সালে এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি চালু হয়। শিক্ষার্থীদের জন্য সরকারি শিক্ষা সুবিধাসহ সব রকম সুযোগ-সুবিধা রয়েছে। শিক্ষার্থীদের খাদ্য সুবিধা ব্যবস্থা আছে। প্রতি শিক্ষার্থীকে খাদ্য ভাতা বাবদ ১২শ আরএমভি দেওয়া হয়। প্রতি সপ্তাহে শিক্ষার্থীদের মেনু বদল হয়। শিক্ষার্থীদের চাহিদা অনুযায়ী খাদ্য সরবরাহ করে কর্তৃপক্ষ। সপ্তাহের মেনুতে কী কী আইটেম থাকবে তা স্কুলের ক্যান্টিনে টাঙিয়ে দেওয়া হয়। নন আবাসিক শিক্ষার্থীরা শুক্র থেকে রোববার পর্যন্ত ছুটি ভোগ করে থাকে। তারা যার যার বাড়িতে চলে যায়। শিশু শিক্ষার্থীদের অসুবিধা হলে তাদের মা-বাবার থাকারও ব্যবস্থা আছে। যা রাষ্ট্র বহন করে। ২ হাজার শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের আবাসন, খাদ্য ব্যবস্থা স্কুল কর্তৃপক্ষ করে থাকে।
 
প্রিন্সিপাল ম্যাম আমাদের স্কুল ক্যাম্পাস ঘুরিয়ে দেখাতে থাকে। শিক্ষার্থীদের জন্য কী নেই স্কুলটিতে। প্রায় সব রকম খেলার মাঠ। পুকুর, ভলিবল মাঠ, ক্রীড়াবিদদের জন্য অনুশীলন ব্যবস্থা, ইনডোর গেম, অডিটরিয়াম, সাংস্কৃতিক কেন্দ্রসহ নামাজের ঘর ইত্যাকার ব্যবস্থা অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে শিক্ষার্থীরা ব্যবহার করে থাকে। প্রিন্সিপাল ম্যাম জানায়, গত বছর চায়নার সেরা ২০ স্কুলের মধ্যে স্থান করে নিয়েছে এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। একটু লজ্জিত কণ্ঠে বলল, ‘আমি সেই সেরা ২০ স্কুলের সেরা শিক্ষক হিসেবে প্রেসিডেন্ট শি জিন পিংয়ের হাত থেকে পুরস্কার গ্রহণ করেছি।’
 
আমরা সবাই তাকে অভিবাদন জানালাম। শিক্ষাব্যবস্থায় চীনারা উদার হলেও ভাষাগত রক্ষণশীলতায় আবদ্ধ। চীনা ভাষার বাইরে অন্য কোনো ভাষা শিক্ষাব্যবস্থা স্কুলগুলোতে নেই। অন্য কোনো ভাষা শিখতে হলে তা নিজ দায়িত্বে শিখতে কোনো প্রতিবন্ধকতাও নেই।
 
বিষয়টি নিয়ে আমি স্বর্ণাকে বললাম, ‘তোমাদের এই নীতিটি আমি গ্রহণ করতে পারিনি। ভাষা শেখায় রক্ষণশীলতা কেন? জ্ঞান-বিজ্ঞানে চীনা জাতি অনেকদূর এগিয়েছে, শুধু ভাষা অন্য শেখায় অন্তঃমুখী। প্রচার মাধ্যমে তোমাদের সরব উপস্থিতি নেই। 
 
বরং তোমাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ভাষায় একতরফা প্রচার করে। তোমরা তার প্রতিবাদ করো না। ভাষার রক্ষণশীলতা তোমাদের এগোতে দেয় না। এটা কোনো শুভ লক্ষণ নয়। বিগত ৩০ বছর গণমাধ্যমে চীনের ধর্মীয় বিভাজনের সুস্পষ্ট ছবি ভেসে বেড়াতে দেখি, বাস্তবে কি তাই? একজন গণমাধ্যমকর্মী হিসেবে আমার তা মনে হয়নি। বরং সম্প্রদায়গত সম্প্রীতির সহাবস্থান আমাকে মোহিত করেছে।’
 
স্বর্ণা লজ্জিত কণ্ঠে বলল, ‘বিষয়টি ঠিক ধরেছেন রেজা ভাই। তবে শিগগির এ ব্যাপারে আমরা সচেতনতার পরিচয় দেব।’
‘ধন্যবাদ।’
 
‘ভাষার ক্ষেত্রে আমরা রক্ষণশীল সত্য। তারও কিছু ঐতিহাসিক কারণ রয়েছে। আমি মানছি নিজস্ব ভাষার পরিভাষা তৈরি হলে অন্য ভাষার প্রয়োজন পড়ে না। চীন তার নিজস্ব পথেই হাঁটবে।’
প্রিন্সিপাল ম্যাম তার শিক্ষা পদ্ধতির যে বিবরণ দিয়েছে, সেদিক দিয়ে আমাদের শিক্ষার সুযোগ-সুবিধার খুব কাছাকাছি। পার্থক্য শুধু চীন একটি অর্থনৈতিক পরাশক্তি। আমরা উন্নয়নশীল। কিছু ঘাটতি তো থাকবেই।
 
জাগো নিউজের ড. হারুন রশীদ ক্ষোভ প্রকাশ করে বলল, ‘ভাষাকে ছড়িয়ে দিলে দেশের জন্য লাভ বেশি।’
 
এ সময় আনন্দী কী যেন বলতে গেলে আমি বললাম, ‘আপনি বাংলা শিখেছেন। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল পড়েছেন। তাতে আপনি লাভবান।’
আনন্দী বলল, ‘সত্য বলেছেন।’
 
প্রিন্সিপাল ম্যামের সঙ্গে স্কুল পরিদর্শন শেষ করতে করতে সন্ধ্যা নামল। চারদিকে আবছায়া। প্রকৃতি এবং আকসু শহর একাকার। রাস্তার পাশে সারি সারি গাছ-গাছালির আড়ালে সন্ধ্যার আগমন টের পাচ্ছি। স্কুল কম্পাউন্ড থেকে বের হয়ে বিকালে শহরের আমেজ অনুভব করলাম। রাস্তায় গাড়ির সংখ্যাও বেড়েছে। গাড়িতে উঠতেই আকাশ বলল, ‘বড় ভাই, এখন আমরা আকসু পুরাতন বাজারে যাব। সেখানে রাতের ডিনার শেষ করে সরাসরি এয়ারপোর্টে, রাত ১১টায় ফ্লাইট। উরুমচি পৌঁছুতে মধ্যরাত।’
 
যে বাজারে আমাদের নিয়ে যাওয়া হয়, তা অনেকটা ঢাকার ইসলামপুরের মতো। সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ৯টার মধ্যে বাজার শেষ। লোকাল ভাষায়Ñস্ট্রিট মার্কেট। তিন ঘণ্টার বাজার। রাস্তার ফুটপাথের ওপর বিভিন্ন পসরা সাজিয়ে বসে স্থানীয় বাসিন্দারা। এটাকে তারা উৎসব মনে করে। উইঘুর সম্প্রদায়ের ইতিহ্যবাহী পণ্যের আনজাম। এ সুযোগে হারুন ভাই পরিজনদের জন্য ২০টি চুলের ব্যান্ড ক্রয় করে। যা অত্যন্ত সস্তা। কিন্তু আভিজাত্যপূর্ণ। এই বাজারে আমাদের কেনার অনেক কিছু থাকলেও সময় স্বল্পতায় কিছুই কেনা হয়নি।
 
ততক্ষণে রাত নামছে। আকবর ভাই বলল, ‘এ বাজারের এক হোটেলে আমরা সবাই ডিনার করব।’ খুবই অবাক হলাম। কয়েক গলি পেরিয়ে যে হোটেলে আমরা রাতের ডিনার করতে বসি, তাতে হোটেলটির আভিজাত্যের বাহার কম বললে ভুল হবে। চীনারা জাতিগতভাবে ভোজনপ্রিয়। অতিথি হিসেবে আমাদের যা পরিবেশন করা হয় তা বাঙালি খাদ্যাভ্যাসের সঙ্গে অনেক মিল রয়েছে।
রাতের ডিনার শেষে আনন্দী বলল, ‘আর দেরি নয়, এখন সরাসরি এয়ারপোর্টে।’ গাড়িতে উঠতেই বুকের ভেতর তোলপাড় করা শূন্যতা অনুভূত হয়। মনে হলো, কিছু মায়া থেকে গেল! 
 
আকসু শহরের অবস্থান এবং এয়ারপোর্টের দূরত্ব বোঝার উপায় নেই। রাতের শহরে এমনিতেই নীরব। আমাদের ক্লান্তি এবং বিষণ্নতা একাকার হয়ে মনে হলো-কিছু দাগ রয়ে গেল।
 
গাড়ি চলছে এয়ারপোর্টের দিকে। গাড়ির বাসিন্দারা গভীর মৌনতায় ডুবে আছে। আমার একবার মনে হলো, যে রাস্তায় সাই সাই করে গাড়ি চলছে. তা একসময় সমুদ্রের তলদেশ ছিল। লাখ লাখ বছরের ব্যবধানে সাগর মরুভূমি হয়েছে। সেই মরুভূমির বুকে চীন সরকার গড়ে তুলেছে বিস্ময়কর এক শহর। লবণাক্ত মাটিতে বৃক্ষরোপণ করে গড়ে তুলেছে সবুজের আধার। বসবাসযোগ্য ভূমি ফসলের মাঠ, স্বচ্ছ পানির নদী, শিল্পায়ন।
 
সেই আকসু শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছি। এ জীবনে আর আসা হবে কি না তাও অজানা। বিশাল মরুভূমি মানুষের বসবাসযোগ্য করে গড়ে তোলার যে অসাধারণ কারিশমা তাতে চীন সরকার আর আকসুর মানুষকে জানাই লাল সালাম। পৃথিবীর মানুষ এ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে। পৃথিবীর পরিত্যক্ত এক ইঞ্চি ভূমি অনাবাদি রাখা ঠিক নয়।  যাবার বেলায় সবুজ শহর আকসুতেই পড়ে থাকে মন।
spot_imgspot_img

মায়ের ঘুমপাড়ানি সুর শান্তিধারা

আমাদের জোনাকজ্বলা গ্রাম বিদ্যুৎ তখনও দেখেনি। সন্ধ্যার কাছে বিকেল নতজানু হতেই সবুজ পাহাড়েরা মিশকালো হয়ে যায়। ফলে- আমরা চালের ফুটো দিয়ে চাঁদ দেখি, আর...

মাহবুবা ফারজানা নতুন তথ্য সচিব

তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের নতুন সচিব হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন বেগম মাহবুবা ফারজানা। তিনি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) ছিলেন। তাকে সচিব পদে পদোন্নতি...

এ এস এ ফাউন্ডেশনের এডুকেশন ফেয়ার প্রতিমাসেই

উচ্চ শিক্ষার্জন, জ্ঞানগর্বের অংশ। বিশ্বব্যাপী ইহার মুক্ত পরিবেশ বিবেচিত হওয়া উচিত। বিশ্বের নাম্বার ওয়ান রাষ্ট্র, যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তির সুযোগ নিয়ে বাংলাদেশে ভর্তি মেলার আয়োজন...

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here