অংগ্যজাই মারমা
মৃত্যুসংবাদ! হ্যাঁ, মৃত্যুর কথাই বলছি। ৮০০ কোটি জনসংখ্যার এই পৃথিবীতে প্রতিদিনই লক্ষাধিক মানুষের মৃত্যু ঘটে। কিন্তু আজ যে বিষয়ের অবতারণা করছি, সেই মৃত্যু কোনো ব্যক্তির মৃত্যু নয়। তা হলো, আমাদের বই পড়ার মৃত্যু। শুনতে খারাপ লাগলেও তারপরও এটাই সত্য। ইদানীং আমাদের পুস্তকের মৃত্যু ঘটছে। কারণ এখন মানুষ আর বই পড়ে না। আপনার কখনো মনে পড়ে আপনি সর্বশেষ যখন বই হাতে নিয়েছিলেন, কিছু সময় ব্যয় করেছেন কোনো মোবাইল হাতে না নিয়ে বা টেলিভিশনে আটকে না পড়ে?
ইদানীং আপনার কি এমন কোনো সময় কেটেছে, যখন শুধু পড়া এবং পড়ার মধ্যে বুঁদ হয়ে বইয়ের পাতা ওলটানো হয়েছে? এমন সময় কি পার করেছেন যে মুহূর্তের জন্য মোবাইল বা টেলিভিশনের সঙ্গে আপনি গাঁটছড়া বাঁধেননি? যদি আপনি এঁদের কেউ না হন, তবে আপনি সৌভাগ্যবান।
পৃথিবীর মুদ্রিত বইয়ের মধ্যে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে পুরোনো বইয়ের সন্ধান মেলে ৮৬৮ সালে, যা একটি বৌদ্ধ ধর্মীয় গ্রন্থ ছিল। পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি বিক্রীত বই হলো বাইবেল। ২০০০ সালের পর সবচেয়ে বেশি ব্যবসাসফল বই হলো হ্যারি পটার। পৃথিবীতে মানুষের জনকল্যাণকর ভূমিকায় সৃষ্ট কাজের মধ্যে সবচেয়ে বড় অবদান ছাপাখানায় বইয়ের মুদ্রণ। আপনি কি একজন গোয়েন্দা হতে চান? আপনি কি একজন বিজ্ঞানী হতে চান? আপনি কি একজন ডাক্তার হতে চান? আপনি কি একজন সাহিত্যিক হতে চান? আপনি যা-ই হতে চান না কেন তার জন্য গুরুর দ্বারস্থ যত না হবেন, তার চেয়ে বেশি সাহায্য করবে আপনার বই। নাকি আপনার কল্পনায় কোনো ভৌতিক জগৎ তৈরি করতে চান? এসব প্রশ্নেরও রসদ জোগাবে বই। চলে যাবেন হ্যারি পটার, ঠাকুর মার ঝুলির জগতে।
কিন্তু চিন্তার জগৎ তৈরির বদলে এসব বইয়ের মধ্য দিয়ে এখন তার বিপরীতে আমাদের আকর্ষণীয় জায়গা হয়ে গেছে মোবাইল। যদি এসবের আপনি কেউ না হয়ে থাকেন, তাহলে আপনাকে ধন্যবাদ। সম্ভবত আপনি তাঁদের মধ্যে একজন ব্যতিক্রমী ব্যক্তি। আপনি এ ধরনের একটি নতুন জগতের অংশীদার নন, যাঁরা নিয়মিত শুধু সোশ্যাল মিডিয়ায় টেক্সট করা এবং নোটিফিকেশন চেক করার মধ্য দিয়ে নিজের জীবনকে সীমাবদ্ধ করে ফেলেছেন। এখন আর বাচ্চারা নিয়মিত খায় না, তারা যত বেশি না খায়, তার চেয়ে বেশি মোবাইল স্ক্রিনের সঙ্গে আবদ্ধ। সাম্প্রতিক গবেষণা অনুযায়ী সারা বিশ্বের মাত্র ৩৬ শতাংশ মানুষ বই পড়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত। এই হার নিতান্তই কম এবং পৃথিবীর জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে ভীতিকর।
সেখানে ভারত একটু ব্যতিক্রম, যেখানে করোনা মহামারির পরে বই পড়ার সংখ্যা বেড়েছে। তবে তা-ও শুধু ব্যক্তিগত উন্নয়ন-সম্পর্কিত। সুকুমার বৃত্তির চর্চা বা আনন্দ লাভের জন্য বই পড়া—তা অতি নগণ্য। বই পড়ার প্রবণতা কমার সঙ্গে সঙ্গে বইয়ের বাজারও তাৎপর্যপূর্ণভাবে কমে গেছে, প্রকাশনা সংস্থাগুলোও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। বিশ্ব বিখ্যাত প্রকাশনী সংস্থা পেঙ্গুইন র্যানডম হাউসকেও নানা ধরনের সমস্যার মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে। জাপানে ৩০ শতাংশের মতো বইয়ের দোকান বন্ধ হয়ে গেছে।
মূলত মানুষের পড়ে আনন্দ লাভের চর্চা হারিয়ে গেছে। এর বিপরীতে অনেকে ই-বুক পড়ছে, নতুবা অডিও বুক শুনছে। হাতে বাঁধানো বই খুব একটা হাতে নিচ্ছে না। কিন্তু সত্য কথা বলতে গেলে হাতে বাঁধা বইয়ের সঙ্গে মানুষের একটা আত্মিক সম্পর্কের বাঁধন রয়েছে, যার মধ্য দিয়ে মানুষ খুব জটিল ধাঁধাগুলো উদ্ধার করে, বিষয়বস্তুর গভীরে প্রবেশ করে, সাহিত্য রস আস্বাদন করে। ইতিহাস, বিজ্ঞানচর্চা, সাহিত্যিক চিন্তাধারা এসব আজ মুছে গেছে ইমোজির বিস্তার এবং চিপসেটের বিকাশের মধ্য দিয়ে।
প্রশ্ন হলো, বই পড়া কি আসলেই মরে গেছে? যুগ হলো যেখানে ছবি তোলা এবং তা সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচার করার, সেখানে বাঁধানো বই হাতে নিয়ে চিন্তার চর্চা কি নির্জীব হয়ে পড়ছে?
অংগ্যজাই মারমা,সরকারি কর্মকর্তা