অর্থভুবন প্রতিবেদক
কাত্তরের ১০ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় অনুচর আলবদর, রাজাকাররা সিরাজুদ্দীন হোসেনকে গভীর রাতে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে। স্বাধীনতার উষালগ্নে তারা বহু বাঙালি বুদ্ধিজীবীকে একইভাবে হত্যা করে। পরাজয়ের মুহূর্তে পাকিস্তানি ও তাদের এ দেশীয় দালালদের বুদ্ধিজীবী হত্যার এই ভয়াবহ পরিকল্পনার উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও তারা যেন দেশ চালাতে না পারে। তাদের সেই চক্রান্ত এখনো অব্যাহত রয়েছে।
অধ্যাপক হামিদা রহমান শহীদ সিরাজুদ্দীন হোসেন সম্পর্কে লিখেছেন, ‘তিনি বিত্তশালী ছিলেন না। তবুও দেশের মানুষ তাঁকে ভালোবাসত। বাংলার মানুষের তিনি অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা কুড়িয়েছিলেন। প্রাচুর্য কিংবা বিলাসিতার মধ্যে তিনি জীবন কাটাননি। দেশবাসীর দুঃখে তিনি সমব্যথী হয়েছেন। জীবনের প্রারম্ভ থেকে জীবনের শেষ কটি মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি বারবার সংগ্রামের মুখোমুখি হয়েছেন। ব্যক্তিজীবনে তিনি ছিলেন এক সরল-সহজ প্রকৃতির মাটির মানুষ। পারিবারিক জীবনে তিনি ছিলেন উদাসীন। সাংবাদিক জীবনে তিনি ছিলেন এক অনলস শ্রমিক। বাংলার মানুষের দুঃখের রাতে, বাঙালির ঝড়ের রাতে তিনি ছিলেন সবার চোখের মণি। তিনি ছিলেন বাঙালির অকৃত্রিম বন্ধু।’
তিনি নিজে বিপুল অর্থবিত্তের অধিকারী না হয়েও মানুষের বিপদে পাশে দাঁড়ানোকে কর্তব্য বলে মনে করতেন। একটি ঘটনার কথা বলি, একাত্তরে যুদ্ধ চলছে। আমাদের একজন সাংবাদিক বন্ধু সমূহ বিপদের সম্মুখীন। তিনি মুক্তিবাহিনীর জন্য কাজ করতেন। খবরাখবর সংগ্রহের জন্য মাঝে মাঝে তিনি গোপনে ঢাকায় আসেন। আর গোপনে সীমান্ত পেরিয়ে ওপারে চলে যান। তিনি যখন ঢাকায় আসতেন, তখন তাঁর পরিচিত দু-একটি জায়গায় যেতেন। একদিন তিনি তাঁরই এক ঘনিষ্ঠ পত্রিকা অফিসে বসে কথা বলছেন, এমন সময় সেই অফিসের টেলিফোন অপারেটর তাঁকে জানান যে তাঁর সেই অফিসে সেই সময়ে তাঁর অবস্থান ক্যান্টনমেন্টে জানানো হয়েছে। কাজেই তিনি সমূহ বিপদের মুখে। এ কথা শোনামাত্র তিনি ওই অফিস থেকে বেরিয়ে পড়েন। সারা দিন গা ঢাকা দিয়ে থেকে রাতে তিনি সিরাজুদ্দীন হোসেনের ৫ নম্বর চামেলিবাগের বাসায় গিয়ে তাঁর বিপদের কথা জানান। তিনি আরও জানান, ওই মুহূর্তে তিনি কপর্দকশূন্য এবং গাড়িভাড়া না থাকায় সীমান্ত পর্যন্ত পৌঁছাতে পারবেন না। যুদ্ধের মধ্যে সিরাজ সাহেব তাঁর বড় সংসার নিয়ে নিজেই হিমশিম খাচ্ছেন এবং কায়ক্লেশে দিন কাটাচ্ছেন। তাঁর হাত তখন একেবারে শূন্য। তিনি তখন একটি চিরকুট লিখে তাঁর এক ছেলেকে পাঠালেন এক প্রতিবেশীর বাড়িতে কিছু টাকার জন্য। প্রতিবেশী ওই ভদ্রলোক নিজের অসুবিধা সত্ত্বেও কিছু টাকা দিয়েছিলেন। সিরাজুদ্দীন হোসেন বিপদাপন্ন ওই সাংবাদিকের হাতে টাকা কয়টি তুলে দিয়ে ওই রাতেই সাবধানে ঢাকা ছাড়তে উপদেশ দেন। এ ধরনের বহু ঘটনা আছে শহীদ সিরাজুদ্দীন হোসেনের জীবনে। এভাবে স্বাধীনতাযুদ্ধকালে বহু মুক্তিযোদ্ধাকে গোপনে সাহায্য করেছেন এবং গোপন তথ্য সীমান্তের ওপারে পাঠিয়েছেন।
মুক্তিযুদ্ধের আগেও দেশের সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তাঁর ভূমিকা ছিল অসাধারণ। ১৯৬৪ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় ইত্তেফাকের পাতায় দাঙ্গার বিরুদ্ধে যেভাবে তিনি কলম চালিয়েছিলেন, তা সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সংগ্রামের ক্ষেত্রে ছিল একটি মাইলফলক। তিনি একদিন এই দাঙ্গার বিরুদ্ধে লিড নিউজের হেডিং দিয়েছিলেন ‘পূর্ব বাংলা রুখিয়া দাঁড়াও’। স্বাধীনতাযুদ্ধকালে অবরুদ্ধ নগরীতে বসে অকুতোভয় সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন যখন একের পর এক রাজনৈতিক নিবন্ধ লিখতে থাকেন, তখন বাংলাদেশের স্বাধীনতার শত্রু হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর পৃষ্ঠপোষক জামায়াতে ইসলামীর মুখপত্র ‘দৈনিক সংগ্রাম’ সিরাজুদ্দীন হোসেন সম্পর্কে লেখে: ‘এ দেশের সরলপ্রাণ ছাত্র-শ্রমিক-জনতা গত চব্বিশ বছর ধরে ঠগ সাংবাদিক ও রাজনীতিকদের পাল্লায় পড়ে ঠকে ঠকে অবশেষে চরম খেসারত দিয়ে এমন শেখাই শিখেছে, যাতে নতুন কোনো ঠগ হাঁটি হাঁটি পা পা করে আবার তাদের ঠকাতে পা বাড়ালে কারোরই দৃষ্টি এড়ায় না। তাই দেখছি কোনো এক ঠগ সাংবাদিকের ঠকামিপূর্ণ ভাষ্য পড়ে এখানকার ছাত্র, শ্রমিক ও জনতার মাঝে গুঞ্জন চলেছে, ইজ্জত যায় না ধুইলে, খাসলত যায় না মইলে। জনতা বুঝেছে, ঠগদের যুক্তিতেও ঠকামির জাদু থাকে। তা দিয়েই তারা সকল জনতাকে বিভ্রান্ত করে নিজেদের মতলব হাসিল করে।’
এরপরও সংগ্রাম পত্রিকা সিরাজুদ্দীন হোসেনকে পাকিস্তানের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে প্রচারণা চালিয়েছে। গণহত্যায় লিপ্ত পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর এ দেশীয় সহযোগী হিংস্র জামায়াতি পশুরা রাও ফরমান আলীর পরিকল্পিত বুদ্ধিজীবী হত্যার তালিকায় সিরাজুদ্দীন হোসেনের নামটি সংগোপনে অন্তর্ভুক্ত করে দেয়।
শহীদ সিরাজুদ্দীন হোসেনের লেখা ও অনুবাদ করা বহু বইয়ের মধ্যে একটি হচ্ছে ‘ছোট থেকে বড়’। এই বইয়ের জীবনীগুলো সেই সব মানুষের, যাঁরা ছোট অবস্থা থেকে বিশ্ববিখ্যাত হয়েছিলেন। তাঁর নিজের জীবনও যেন এই গ্রন্থের নেপথ্যে মিশে ছিল। পাঁচ বছর বয়সে পিতৃহারা হয়ে প্রচণ্ড সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তিনি নিজেকে যে অবস্থানে টেনে তুলেছিলেন তা ছোট থেকে বড় হওয়ারই এক সংগ্রামমুখর কাহিনি। একাত্তরে ঘাতকদের হাতে তিনি যখন শহীদ হন, তখন তাঁর বয়স মাত্র ৪৩ বছর। স্বাধীনতা-উত্তরকালে দেশসেবার বৃহত্তর ক্ষেত্রে তাঁর সংগ্রামী জীবনের বিকাশের যে উজ্জ্বল সম্ভাবনা ছিল, ঘাতকের খড়্গ তার ওপর যবনিকা টেনে দেয়। দেশ বঞ্চিত হয় এক সত্যনিষ্ঠ, ত্যাগী ও মেধাবী মানুষের সেবা থেকে।
রোকনুজ্জামান খান দাদাভাইয়ের স্মৃতিচারণামূলক লেখার একটি অংশ উদ্ধৃতি দিয়ে এ লেখার সমাপ্তি টানব। তিনি লিখেছেন: ‘আমার বাম হাতে বাঁধা ঘড়িটির দিকে যখন চোখ পড়ে, মাঝে মাঝে একটি ঘটনার কথা স্মৃতিতে ভেসে ওঠে। ১৯৫৪ সালের কথা। সিরাজুদ্দীন হোসেন তখন ফ্রাঙ্কলিন পাবলিকেশন্সে সম্পাদনার দায়িত্বে নিয়োজিত।
আমাকে একদিন ডেকে শিশুদের একটি ইংরেজি গ্রন্থ অনুবাদ করতে দিলেন। আমি কাজটি শেষ করে পাণ্ডুলিপি জমা দিলাম। মুদ্রিত হয়ে বইটি বের হলো। অনুবাদের জন্য আমি যে টাকা পেলাম তাই দিয়ে কিনলাম এই ঘড়িটি। আজও সেটি বিশ্বস্ত বন্ধুর মতো আমাকে সাহায্য করে চলেছে। সিরাজুদ্দীন হোসেন অনেককেই নানাভাবে সাহায্য করেছেন। কিন্তু আমাদের দুঃখ, প্রতিদান দেওয়ার সুযোগ তিনি কাউকে দিলেন না। স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মের মাত্র পাঁচ দিন আগে তিনি শহীদ হন। দেশকে ভালোবাসার চরম মূল্য দিয়ে স্বাধীনতাবিরোধীদের হাতে প্রাণ দিলেন।’