অর্থভুবন প্রতিবেদক
জুড়ির ফুলতলা চা-বাগানে জন্ম আমার। বাবা অমৃত সিং, মা রতনমণি সিং ভূমিজ। তিন ভাই-বোনের মধ্যে আমি বড়। সবাই আমাকে অঞ্জু বলে চেনে।
মা-বাবা দুজনই চা শ্রমিক। ১৭০ টাকা করে দৈনিক মজুরি। আমাকে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি করিয়েছিলেন নিবারণ জ্যাঠা। প্রথমদিকে পড়ালেখার গুরুত্ব বুঝতেন না বাবা।
কিন্তু মা চাইতেন পড়াশোনা করে আমি যেন বড় কিছু করি। তিনি বলতেন, ‘বাবা লেখাপড়া কর, নিজের পায়ে দাঁড়া। বড় হলে তুই নিজের মতো করে চলতে পারবি।তর বাপের যে রুজি, অইটা দিয়ে সংসার চলে না।’
আসলে মা চেয়েছিলেন বলেই পড়ালেখা চালিয়ে যেতে পেরেছি। তখন চা-বাগানের ছেলেমেয়েরা মার্বেল খেলা, বিভিন্ন গুটি খেলা বা আড্ডাবাজিতে ব্যস্ত থাকত। পড়ালেখা নিয়ে কারো মাথাব্যথা ছিল না। এসব দেখে মা আমাকে খুব করে বোঝাতেন।
মা বললেন, ‘দেখ, তুই স্কুল কামাই করলে বৃত্তি পাবি না।’ তখন ১৫০ টাকা বৃত্তি দিত। কিন্তু স্কুল কামাই করলে তা পাওয়া যেত না। টাকাটা খুব দরকার ছিল। কারণ সংসারে ‘নাই’ আর ‘নাই’।
অঞ্জনের র্যাগ ডেতে এসেছিলেন তাঁর মা-বাবা
মায়ের সঙ্গে কাজে যেতাম
জুতা দূরে থাক, কখনো স্যান্ডেল পরে স্কুলে যেতে পারিনি। পঞ্চম শ্রেণির পর ফুলতলা বশির উল্লাহ উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম। প্রাইমারি স্কুলে বেতন লাগত না। কিন্তু হাই স্কুলে মাসিক বেতন দিতে হতো। তখন মা চা-বাগান ছেড়ে খাসিয়াপুঞ্জিতে যাওয়া শুরু করেন। ৪০ টাকা মজুরি পেতেন। ছুটির দিনগুলোতে তাঁর সঙ্গে আমিও যেতাম। আমাকে ৩০ টাকা মজুরি দিত। স্কুলে সহপাঠীদের অনেকে আমাকে ‘বাগানি’, ‘লেবার’ ইত্যাদি বলে খেপাত।
ওই রুমে ঢুকব
সেভেন-এইটে পড়ার সময় দেখতাম, টিফিনের পর সায়েন্সের ছাত্রদের স্যাররা ল্যাব রুমে নিয়ে যেতেন। আমাদের সেখানে প্রবেশাধিকার ছিল না। তখন থেকে ভাবতাম, আমিও সায়েন্সে পড়ব। ওই রুমে ঢুকব।
জেএসসির পর সায়েন্সে ভর্তি হলাম। কিন্তু প্রতিবেশীদের অনেকে বাবাকে বলল, ‘সায়েন্স খুব কঠিন। অঞ্জু পারবে না। তোরা কি অঞ্জুকে প্রাইভেট পড়াবি?’
শুরুর দিকে একদিন স্যার এসে জানতে চাইলেন, তোমরা কে কে সায়েন্স নিয়েছ? অনেকের সঙ্গে আমিও দাঁড়ালাম। স্যার আমাকে বললেন, ‘বর্গের বেসিক সূত্র বলো?’ ভয়ে বর্গের বদলে মান নির্ণয়ের সূত্র বলে ফেললাম। স্যার এসে আমার গালে কষে এক চড় বসিয়ে দিলেন। বললেন, ‘বেটা, তোকে জীবনে ক্লাসে দেখিনি। চা শ্রমিকের পোলা আইছে সায়েন্সে পড়তে!’
এরপর আরো কয়েকজন স্যার বলেছিলেন, ‘তুই বাগানের ছেলে। তোর বাবা বাগানে কাজ করে। তোকে প্রাইভেট পড়াতে পারবে না। তুই মানবিকে পড়।’
প্রথম সাময়িক পরীক্ষায় রসায়নে ৫০-এর মধ্যে মাত্র দুই পেয়েছিলাম। হেডস্যার আমাকে ডেকে বললেন, ‘বেটা, তুই সায়েন্স পারবি না। পাঁচ হাজার টাকা দিতে পারবি? বোর্ডে গিয়ে সায়েন্স থেকে তোর নামটা বাদ দিয়ে দেব।’ তবু অনড় রইলাম। যা হোক, ২০১৪ সালে এসএসসিতে জিপিএ ৪.১৩ নিয়ে পাস করি।
জীবিকার তাগিদে পাহাড় থেকে কচু এনেছেন অঞ্জন
চা-বাগানে ছিলাম
এসএসসির পর তৈয়বুন্নেছা খানম সরকারি কলেজে ভর্তি হলাম। কলেজে এক স্যার বলেছিলেন, ‘তোদের এলাকার কলেজে কমার্স নিয়ে পড়। সায়েন্স পড়া টাকার ব্যাপার, কোথা থেকে তোর বাবা টাকা দেবে।’
বাসা থেকে কলেজ প্রায় ২২ কিলোমিটার দূরে। কলেজজীবন গেছে বিভিন্ন চা-বাগানের আত্মীয়দের বাসায় থেকে। কাপনাপাহাড়, সোনারপা চা-বাগান এবং ধামাই চা-বাগানে ছিলাম। প্রতি সপ্তাহে বাসা থেকে চাল, সবজি ইত্যাদি নিয়ে যেতাম। পদার্থ, রসায়ন ইত্যাদি বিষয়ের জন্য প্রাইভেট পড়তেই হতো। বাবা ঋণ নিয়ে প্রাইভেটের টাকা দিতেন। এইচএসসির সময় বিভিন্ন কোচিং সেন্টারের পোস্টার দেখি। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার ইচ্ছা জাগে। পরে এক কোচিং সেন্টারে ভর্তি হলাম। ২০১৬ সালে জিপিএ ৩.৯২ নিয়ে এইচএসসি পাস করি। সিলেটে কোথায় থেকে কোচিং করব—এ নিয়ে দ্বিধায় ছিলাম। বাড়ির পাশের এক পিসির বিয়ে হয়েছে সিলেট শহরের কাছেই কাদিম চা-বাগানে। তাঁর বাসায় থেকে কোচিং করতাম।
প্রথমবার সুযোগ মেলেনি
প্রথমবার ৯টি বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দিয়েছিলাম। পাস করেছিলাম শুধু মাওলানা ভাসানীতে। ‘বি’ ইউনিটে কোটায় ২৬তম হয়েছিলাম। কিন্তু ২৫ জনের পর আর ডাকেনি। দ্বিতীয়বার বাসায় প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করলাম। প্রায়ই কাঁদতাম। মা আমাকে বোঝাতেন। বাবা একদিন বললেন, ‘তুই আবার পরীক্ষা দে। ভিক্ষা করে হলেও তোকে পড়াব।’
২০১৭ সালে নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ইউনিটে ৩৫তম, বি ইউনিটে ২২তম এবং মাওলানা ভাসানীতে কোটায় ‘বি’ ইউনিটে ১৬তম এবং ‘সি’ ইউনিটে প্রথম হয়েছিলাম। মাওলানা ভাসানীতে পদার্থবিজ্ঞানে ভর্তির সিদ্ধান্ত নিলাম। কিন্তু ভর্তির টাকা কই পাব? বাগানের এক বাবুর কাছ থেকে ২০ হাজার টাকা ধার নিলেন বাবা। ভাইভার সময় তৎকালীন প্রক্টর সিরাজুল ইসলাম আমার সব বিষয়ে খোঁজ নেন। তিনি ভর্তির ব্যবস্থা করে দিলেন। তখন আমার বিভাগের সিনিয়ররা, স্যার, বন্ধুবান্ধব সবাই সাহায্য করেছিলেন।
বন্ধুরা বই-খাতা, জুতা, এমনকি পোশাকও কিনে দিয়েছিল। এলাকার কাওছার ভাই আমার জন্য একটা টিউশনি ঠিক করে দিয়েছিলেন। এভাবেই চলছিল বিশ্ববিদ্যালয়জীবন।
টিউশনি হারালাম
একটা সময় তিনটা টিউশনি করাতাম। ভালোই চলছিল। একসময় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে নিজের জীবনকাহিনি বলে ফেলি। আমি ভূমিজ সম্প্রদায়ের সন্তান, চা-বাগানে বড় হয়েছি—এটা সহজভাবে নিতে পারেননি অভিভাবকরা। পরে একে একে তিনটি টিউশনি থেকেই ‘না’ করে দিল। তখন কোনো মতে খেয়ে না খেয়ে দিন পার করতাম। আমার এক বন্ধু ক্যাম্পাসে নাশতা সরবরাহের ব্যবসা করত। একদিন আমাকে বলল, ‘খাবার ডেলিভারি দিতে পারবি?’ রাজি হয়ে গেলাম। হলের রুমে রুমে খাবার দিতাম। প্রতিদিন ১০০ টাকা পেতাম।
কাজ খুঁজতাম
বাবাকে টাকার কথা বললে তিনি মহাজন বা এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে দিতেন। তারপর ঋণের বোঝা টানতে হতো। তাঁকে যেন এমনটি করতে না হয় সে জন্য সব সময় কাজ খুঁজতাম। ঈদ-পূজাসহ অন্যান্য ছুটিতে বাড়ি গেলে পুঞ্জিতে কাজ করতাম। সব ধরনের কাজই করি। কারো ধান কেটে দিই, মাটি কাটি কিংবা ধান রোপণ করি। করোনার সময় লোকের পোষা প্রাণীকে খাওয়ানোর জন্য পাহাড় থেকে কচু এনে দিতাম। মহামারির পুরো সময় পুঞ্জিতে কাজ করেছি। সকালে যেতাম, সন্ধায় আসতাম।
কয়েক মাস আগে অনার্সের ফাইনাল পরীক্ষা হয়েছে। গত ৫ সেপ্টেম্বর অষ্টম সেমিস্টারের রেজাল্ট দিয়েছে। বি মাইনাস পেয়ে পাস করেছি। মনে হচ্ছে যেন সুড়ঙ্গের শেষে আলো দেখছি। ভীষণ ভালো লাগছে।
এখন মাস্টার্সে পড়ছি। সামনে ডাটা সায়েন্স নিয়ে উচ্চতর ডিগ্রি নিতে চাই।
সবাইকে নিয়ে এগোতে চাই
শুধু নিজেকে নিয়ে ভাবিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর থেকে চেয়েছি নিজ সম্প্রদায়ের ছেলেমেয়েদের সংগঠিত করতে। ফেসবুকে গ্রুপ করেছি। তাদের জন্য ফ্রি অনলাইন কোচিংও চালু করেছি। এখন ভূমিজ সম্প্রদায়ের আরো ছয়জন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। যতটুকু সম্ভব তাদের পাশে থাকার চেষ্টা করছি। স্বপ্ন দেখি, একদিন আমার মতো ভূমিজ সন্তানদের সবাই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে। টাকার জন্য কারো পড়াশোনা বন্ধ হবে না।
একনজরে ভূমিজ
ভূমিজ মানে ভূমির সন্তান। এই সম্প্রদায়ের আদিনিবাস ভারতের বিহারে। বিশ শতকের প্রথম দিকে তারা সিলেট অঞ্চলে আসে। এখানকার চা-বাগানে কাজ শুরু করে। বর্তমানে মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গলে চা শ্রমিক হিসেবে তারা বাস করছে। ভূমিজদের সংখ্যা প্রায় তিন হাজার। সূত্র : বাংলাপিডিয়া