প্রকৌশলী মো. কামরুজ্জামান
প্রাক-ইসলামিক যুগে কন্যাসন্তানদের অবস্থা ছিল খুবই নাজুক। কন্যাসন্তানদের পিতা হওয়াকে অপমানজনক মনে করা হতো। কারো কন্যাসন্তান জন্ম নিলে সে খুবই মর্মাহত হতো; এমনকি কেউ কেউ তাকে হত্যাও করে ফেলত। এ অবস্থায় আরবের বর্বরতার অন্ধকার যুগের নারীদের প্রতি অমানবিক নির্যাতন নিষিদ্ধ করে ইসলাম যে প্রয়োজনীয় বিষয়ে নারীদের ন্যায়সংগত অধিকার প্রদান করেছে তা নিয়ে নিম্নে আলোচনা করা হলো—
শিক্ষাগত অধিকার
ইসলামধর্মে জ্ঞানার্জনকে অতীব গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে।
অর্থাৎ পুরুষের যেমন শিক্ষার অধিকার আছে, তেমনি নারীরও শিক্ষার অধিকার আছে, যা উভয়ের জন্য অবশ্যই পালনীয়।
ইসলামে নারীর অর্থনৈতিক অধিকার
ইসলামে পরিবার-পরিজন চালানোর জন্য, ভরণ-পোষণের জন্য নারীর অর্থ-উপার্জনের প্রয়োজন নেই, কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। নারীরা যদি অর্থ উপার্জন করে তাহলে তা তাদের নিজস্ব সম্পদ বলে পরিগণিত হয়। এ সম্পদসহ অন্য উৎস থেকে প্রাপ্ত সম্পদের কর্তৃত্ব শুধু তাদেরই থাকে।
কোরআন ও হাদিসে কোথাও নারীর কাজ করার বাধা-বিপত্তি আরোপ করা হয়নি। তবে শর্ত হলো, এ কাজ শরিয়তের সীমার মধ্যে হতে হবে। অর্থনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নমূলক কাজে নারীদের অংশগ্রহণের সুযোগ ইসলাম দিয়েছে।
এ জন্য দেখা যায়, তৎকালে মুসলিম নারীরা অবস্থাভেদে ব্যবসা-বাণিজ্য, কৃষিকাজ, শিল্প ও কারুকর্মে অংশগ্রহণ করতেন।
ইসলাম নারীদের পিতা-মাতার সম্পত্তিতে উত্তরাধিকারের অধিকার প্রদান করেছে। এ ব্যপারে কোরআন শরিফে একাধিক আয়াতে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। কোরআন শরিফের সুরা বাকারা, সুরা নিসা, সুরা মায়েদায় বলা হয়েছে যে নারীরা স্ত্রী হিসেবে, মা হিসেবে, কন্যা হিসেবে, বোন হিসেবে সম্পত্তিতে উত্তরাধিকার লাভের অধিকারী হবে। এ ছাড়া ইসলামে নারীদের বিয়েতে মোহরানার (দেনমোহর) ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এর মাধ্যমে তারা সম্পদ লাভ করে। এ সম্পদের ওপর একচ্ছত্রভাবে অধিকার শুধু নারীরই আছে।
ইসলামে নারীর পরকালীন কল্যাণের অধিকার
পরকালীন কল্যাণেও পুরুষদের মতো নারীদের অধিকার আছে। কোরআন শরিফে বলা হয়েছে, ‘আর যে সৎকাজ করবে সে পুরুষ হোক বা নারী, যদি সে ঈমানদার হয় তবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। আর কারো ওপর বিন্দুমাত্র অবিচার করা হবে না।’ (সুরা নিসা, আয়াত : ১২৪)
এ ব্যাপারে কোরআন শরিফের আরেকটি সুরা নাহলে বলা হয়েছে, ‘পুরুষ বা নারীর মধ্যে যে কেউ সৎকাজ করবে, যদি সে মুমিন হয় তাহলে তাকে আমি দুনিয়াতে পবিত্র জীবন যাপন করাব এবং পরকালের জীবনেও এদের সৎকর্মের বিনিময়ে উত্তম পুরস্কার দেব।’ (সুরা নাহল, আয়াত : ৯৭)
এ দুটি আয়াত থেকে সুস্পষ্টভাবে দেখা যায়, জান্নাত লাভের জন্য তথা পরকালের কল্যাণ লাভের জন্য নারী-পুরুষ উভয়েরই সমান অধিকার।
কন্যা হিসেবে নারীর অধিকার
ইসলাম ধর্ম আবির্ভাবের পূর্বে আরবরা নিজেদের সন্তানদের দারিদ্র্যের কারণে হত্যা করত। ইসলাম সন্তান হত্যা হারাম ঘোষণা করে পুত্র-কন্যাদের এ থেকে সুরক্ষা প্রদান করেছে। কোরআন শরিফে বলা হয়েছে, ‘তোমাদের সন্তানদের দারিদ্র্যের ভয়ে হত্যা করো না; তাদের এবং তোমাদেরও আমি রিজিক (আহার) প্রদান করি। তাদের হত্যা করা মহাপাপ।’ (সুরা বনি ইসরাঈল, আয়াত : ৩১)
ইসলামে পুত্রসন্তান ও কন্যাসন্তানের মধ্যে মর্যাদাগত কোনো পার্থক্য নেই। ইসলামে কন্যাসন্তানকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করাকেও নিষেধ করেছে। মুহাম্মদ (সা.) আরো বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি তার কন্যাসন্তানের কারণে কোনোরূপ পরীক্ষার সম্মুখীন হয় (বিপদগ্রস্ত হয়) সে তাদের ব্যাপারে ধৈর্য ধারণ করলে তারা তার জন্য জাহান্নাম থেকে আবরণ (প্রতিবন্ধক) হবে।’ (তিরমিজি)
স্ত্রী হিসেবে নারীর অধিকার
ইসলামে স্ত্রী হিসেবে নারীর অধিকার ও মর্যাদা স্বামীর অনুরূপ। কোরআন শরিফে বলা হয়েছে, ‘পুরুষদের যেমন স্ত্রীদের ওপর ন্যায়সংগত অধিকার আছে, তেমনি স্ত্রীদেরও অধিকার আছে পুরুষদের ওপর।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ২২৮)
স্ত্রী হিসেবে শুধু ন্যায়সংগত অধিকারই নয়, সম্মানজনক আচরণ ও উত্তম ব্যবহারও নারীর প্রাপ্য। এ ব্যাপারে কোরআন শরিফে বলা হয়েছে, ‘তোমরা স্ত্রীদের সঙ্গে উত্তম ব্যবহার করে জীবনযাপন করবে। এমনকি যদি তাদের অপছন্দ কর, তবে হয়তো তোমরা এমন জিনিসকে অপছন্দ করছ, যার মধ্যে আল্লাহ অশেষ কল্যাণ নিহিত রেখেছেন।’ (সুরা নিসা, আয়াত : ১৯)
মাতা হিসেবে নারীর অধিকার
কোরআন শরিফে আল্লাহ পাক নির্দেশ দিয়েছেন, ‘আর ইবাদত করো আল্লাহর, শরিক করো না তার সঙ্গে অন্য কাউকে, আর পিতা-মাতার সঙ্গে সৎ ও সদয় ব্যবহার কোরো।’ (সুরা নিসা, আয়াত : ৩৬)
ইসলামবিরোধী পিতা-মাতার ব্যাপারেও সন্তানের দায়িত্ব সম্বন্ধে কোরআন শরিফে আল্লাহ পাক বলেন, ‘যদি তারা (পিতা-মাতা) উভয়ে তোমাকে ওই বিষয়ের ওপর পীড়াপীড়ি করে যে তুমি আমার সঙ্গে শিরক করবে, যে ব্যাপারে তোমার কোনো জ্ঞানই নেই, তাহলে তুমি তাদের দুজনের (কারোরই) কথা মানবে না, তবে দুনিয়ার জীবনে তুমি অবশ্যই তাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করবে।’ (সুরা লোকমান, আয়াত : ১৫)
নারীর পছন্দমতো বিয়ের অধিকার
ইসলাম নারীকে তার পছন্দমতো বিয়ে করার অধিকার দিয়েছে। আবু হুরায়রা (রা.) এ হাদিস বর্ণনা করেছেন যে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘কোনো বিধবা নারীকে তার সম্মতি ছাড়া বিয়ে দেওয়া যাবে না। (সাহাবি) জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসুল, তার অনুমতি কিভাবে নেব? তখন তিনি বললেন, জিজ্ঞেস করার পর নীরব থাকাই তার অনুমতি।’ (বুখারি)
আর কুমারী নারীর বিয়ের ব্যাপারে আয়েশা (রা.) রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল, একটি কুমারী নারী তো লজ্জাবোধ করে। তিনি বলেন, চুপ থাকাই তার অনুমতি।’ (বুখারি)
নারীর অপবাদ থেকে সুরক্ষার অধিকার
বর্তমান সমাজে দেখা যায়, একশ্রেণির পুরুষ হীনস্বার্থে ভদ্র পরিবারের নারীর ওপর অপবাদ আরোপ করছে; সংশ্লিষ্ট নারীর ছবি অন্য খারাপ নারীর ছবির সঙ্গে সম্পাদন (Edit) করে অশ্লীল ছবিতে রূপান্তরিত করে জঘন্য কুৎসা রটনা করে প্রচারমাধ্যম ইউটিউব, ফেসবুকে দিচ্ছে। এতে সংশ্লিষ্ট সতী-সাধ্বী নারী ও তার পরিবার-পরিজনকে অসহনীয় অবস্থায় পড়তে হচ্ছে। এ রকম অপবাদ থেকে নারীর সুরক্ষা পাওয়ার জন্য কোরআন শরিফে বলা হয়েছে, ‘যারা সতী-সাধ্বী নারীর ওপর ব্যভিচারের অপবাদ আরোপ করে এবং এর স্বপক্ষে চারজন সাক্ষী উপস্থিত করতে না পারে, তাদের ৮০টি বেত্রাঘাত করবে এবং কখনো তাদের সাক্ষ্য গ্রহণ করবে না।’ (সুরা নুর, আয়াত : ৪)
পরিশেষে মানবসভ্যতার ইতিহাসে দেখা যায়, ইসলামই ১৪০০ বছর আগে নারী জাতিকে প্রকৃত মর্যাদা ও ন্যায়সংগত অধিকার প্রদান করেছে। এ জন্যই প্রখ্যাত অমুসলিম মনীষী পিয়েরে ক্রাবাইট (Pierre Crabite) ইসলাম ধর্মের প্রবক্তা (আল্লাহ পাক থেকে প্রাপ্ত ইসলাম ধর্মের প্রচারক) মুহাম্মদ (সা.) সম্বন্ধে অভিমত প্রকাশ করেন যে ‘Muhammad was the world greatest Champion of women’s rights the world has ever seen.’ [মুহাম্মদ (সা.) হলেন নারী অধিকার প্রদানের ক্ষেত্রে সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব, যা পৃথিবীতে আর কখনো দেখা যায়নি]
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা