অর্থভুবন প্রতিবেদক
আল্লাহ মানুষকে বিভিন্ন প্রকৃতিতে সৃষ্টি করেছেন। একেক বিষয়ে একেকজন পারদর্শী। পৃথিবীর সব বিষয়ে একজন পারদর্শী এমন কোনো মানুষ দুনিয়াতে নেই। এজন্য আমাদের কোনো কাজ করার প্রয়োজন হলে আমরা পরামর্শ করি।
আল্লাহ আমাদের প্রিয় নবিকে পরামর্শের আদেশ করেছেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, তারা (মুসলমানরা) পারস্পরিক পরামর্শক্রমে কাজ করে (সূরা আশ-শুরা ৩৮)।
পরামর্শ এত অত্যধিক গুরুত্বের কারণে প্রিয় নবি (সা.) সবচেয়ে বেশি পরামর্শ করতেন। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা.) থেকে সাহাবায়ে কেরামের সঙ্গে বেশি পরামর্শকারী অন্য কাউকে দেখিনি (সহিহ ইবনে হিব্বান, ৪৮৭২)। রাসূল (সা.) যেখানে এত বেশি পরামর্শের গুরুত্ব দিতেন, সেখানে আমরা তো এর প্রতি আরও বেশি এর মুখাপেক্ষী।
আমরা ব্যক্তিগত কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগি, সিদ্ধান্ত গ্রহণে হিমশিম খেতে হয়। তখন সে বিষয়ে পরামর্শ করলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ সহজ হয়। সে জন্য রাসূল (সা.) ব্যক্তিগত জীবনেও পরামর্শ করার জন্য উদ্বুদ্ধ করেছেন।
ফাতেমা বিনতে কাইস (রা.) বলেন, একবার আমি নবি (সা.)-এর কাছে উপস্থিত হয়ে নিবেদন করলাম যে, মুআবিয়া ইবনে আবু সুফয়ান (রা.) ও আবু জাহম (রা.) আমাকে বিবাহের পায়গাম পাঠিয়েছেন। (এ ক্ষেত্রে আমি কী করব?) রাসূল (সা.) বললেন, আবু জাহম এমন লোক যে, তার কাঁধ থেকে লাঠি নামায় না। আর মুআবিয়া তো নিঃসম্বল, গরিব মানুষ। বরং তুমি ওসামা ইবনে জায়েদের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হও। কিন্তু আমি তাকে পছন্দ করলাম না।
পরে তিনি আবার বললেন, তুমি ওসামাকে বিয়ে করো। কিন্তু আমি তাকে পছন্দ করলাম না। তিনি আবার বললেন, তুমি ওসামাকে বিয়ে করো। তখন আমি তার সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হলাম। আর আল্লাহ এতে (তার ঘরে) আমাকে বিরাট কল্যাণ দান করলেন। আর আমি ঈর্ষার পাত্রে পরিণত হলাম’ (সহিহ মুসলিম-৩৫৮৯)।
নবি (সা.) রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সাহাবাদের সঙ্গে পরামর্শ করতেন। হাদিসের কিতাবে এ সংক্রান্ত অনেক ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। বদর যুদ্ধের প্রাক্কালে, উহুদের যুদ্ধের সময়, হুদাইবিয়াসহ বিভিন্ন যুদ্ধে রাসূল (সা.) সাহাবাদের সঙ্গে গুরুত্বসহ পরামর্শ করেছেন। আর সাহাবায়ে কেরাম প্রত্যেকেই নিজের মতামত রাসূলের সামনে পেশ করেছেন।
যে কোনো বিষয়ে যে কারও সঙ্গে পরামর্শ করা যাবে না। এ ক্ষেত্রে আমাদের লক্ষ রাখতে হবে, আমি যে বিষয়ে পরামর্শ করব, তা এমন ব্যক্তির সঙ্গে হওয়া চাই, যে সে বিষয়ে অভিজ্ঞ। যদি তার সে বিষয়ে কোনো জ্ঞানই না থাকে, তাহলে তার সঙ্গে পরামর্শ করে কোনো উপকার আসবে না। সেজন্য যার সঙ্গে পরামর্শ করব, তার ব্যাপারে ভালোভাবে অবগত হওয়া। ইলেমহীন বেদ্বিন লোকদের সঙ্গে পরামর্শের মধ্যে সুফলের চেয়ে কুফল বেশি।
অনেকের ধারণা, পরামর্শ শুধু বড়দের সঙ্গেই করা হয় বা তাদের সঙ্গেই করা জরুরি। এ ধারণা ঠিক নয়, বরং বড়দের সঙ্গে পরামর্শ করা উচিত। তাদের অবর্তমানে নিজের সমবয়সি বা ছোটদের সঙ্গেও পরামর্শ করতে সমস্যা নেই। আমাদের নবি সর্বশ্রেষ্ঠ মানব ছিলেন। তবু আল্লাহতায়ালা তাঁকে সাহাবাদের সঙ্গে পরামর্শ করার নির্দেশ দিয়েছেন। এ থেকে প্রতীয়মান হয়, পরামর্শের ক্ষেত্রে বড়রা কোনোভাবেই অমুখাপেক্ষী নয়। তাদেরও ছোটদের সঙ্গে পরামর্শ করা উচিত।
আমার কাছে কোনো ব্যক্তি যদি কোনো বিষয়ে পরামর্শ চায়, তাহলে সে ক্ষেত্রে আমাকে অবশ্যই তাকে উত্তম পরামর্শ দিতে হবে। যদি সে বিষয়ে আমার কোনো অভিজ্ঞতা আর তেমন জানাশোনা না থাকে, তাহলে তাকে কোনো পরামর্শ না দেওয়া। আর পরামর্শের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ আমানতদারিতা রক্ষা করা। এ পরামর্শের কারণে তার মনে কষ্ট পাওয়া কিংবা অন্য কোনো ক্ষতির দিকে দেখা ভিন্ন পরামর্শ না দেওয়া। কিংবা শুধু মনোরঞ্জনের জন্যই পরামর্শ দিয়ে দেওয়া-এসব থেকে বিরত থাকতে হবে।
আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবি (সা.) বলেছেন, আমি যা বলিনি তা যে ব্যক্তি আমার প্রতি আরোপ করবে সে যেন দোজখে তার স্থান করে নিল। কোনো ব্যক্তির কাছে তার কোনো মুসলমান ভাই পরামর্শ চাইল, কিন্তু সে তাকে ভ্রান্ত পরামর্শ দিল। সে তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করল। আর যে ব্যক্তি দলিল-প্রমাণ ছাড়াই ফতোয়া দিল, তার এ ফতোয়াদানের পাপ তার ওপর বর্তাবে (আল-আদাবুল মুফরাদ-২৫৮)।
পরামর্শের মাধ্যমে কোনো কাজ করা হলে সবচেয়ে বড় ফায়দা হচ্ছে, প্রত্যেকের সুন্দর সুন্দর মতামত সামনে আসে। যখন প্রত্যেকের ভেতরের সুন্দর জিনিসগুলো সামনে আসে, তখন এর মাধ্যমে সুন্দর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সহজ হয়। পাশাপাশি এর মাধ্যমে পরস্পর সামাজিক বন্ধন সুদৃঢ় হয়। যাদের সঙ্গে নিয়ে পরামর্শ করা হয় তাদের মনোরঞ্জনও হয়।