বদরুল ইসলাম
দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল প্রাণিসম্পদের উন্নয়নের এক অপার সম্ভাবনাময় অঞ্চল। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল বলতে এখানে খুলনা বিভাগকে ধরা হয়েছে। প্রায় ১ কোটি ৪৩ লাখ জনসংখ্যা অধ্যুষিত এ অঞ্চলে রয়েছে ৫৯টি উপজেলা, একটি মেট্রো থানা ও ১০টি জেলা। গবাদি পশু ও পোলট্রির উত্পাদন বৃদ্ধি ত্বরান্বিত করা, গৃহস্থ পর্যায়ে খাদ্য ও পুষ্টির নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, গবাদি পশু পালন, হাঁস-মুরগি পালন, দুগ্ধ প্রক্রিয়াকরণ, পশুস্বাস্থ্যের উন্নয়ন এবং প্রাণিসম্পদকেন্দ্রিক সম্প্রসারণ কর্মকাণ্ড জোরদারকরণের লক্ষ্যে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে সম্পূর্ণ জিওবির অর্থায়নে গ্রহণ করা হয় ৫৫ কোটি টাকা ব্যয়ের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রাণিসম্পদ উন্নয়ন প্রকল্প।
প্রকল্পের প্রধান অঙ্গগুলো হচ্ছে :(ক) প্রদর্শনী ও ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে প্রাণিসম্পদ প্রযুক্তির হস্তান্তর, (খ) প্রকল্প এলাকায় অবকাঠামোগত উন্নয়ন, (গ) গবাদি পশু লালন-পালনকারী অর্থাত্ খামারি ও কমিউনিটি লাইভস্টক এক্সটেনশন ভলেন্টিয়ার প্রশিক্ষণ।
প্রকল্পের আওতায় গবাদি পশুর জন্য ভ্যাকসিনেশন ক্যাম্পেইন, ডিওয়ার্মিং ক্যাম্পেইন, গরু হূষ্টপুষ্টকরণ প্যাকেজ, ডেইরি ডেমোনেস্ট্রেশন প্যাকেজ, কাফপেন ডেমোনেস্ট্রেশন প্যাকেজ, লেয়ার মুরগি পালন প্যাকেজ, ব্যাকইয়ার্ড পোলট্রি পালন প্যাকেজ, ছাগল ডেমোনেস্ট্রেশন প্যাকেজ, খামারের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্যাকেজ, স্বাস্থ্যসম্মতভাবে দুধ সংগ্রহ প্যাকেজ, প্রাথমিকভাবে দুধ প্রক্রিয়াজাতকরণ প্যাকেজ, ফডার ডেমোনেস্ট্রেশন প্যাকেজ, ভেটেরিনারি মেডিক্যাল প্যাকেজের মাধ্যমে প্রত্যক্ষভাবে ৪ হাজার ৩৩৬ জন খামারিকে গবাদি পশু লালন পালনে বিভিন্ন উপকরণ বিনা মূল্যে প্রকল্প থেকে দেওয়া হয়েছে। যেমন মাচায় ছাগল পালনের জন্য ৩০০ জন ছাগল পালনকারীকে ছাগলের মাচাসহ ঘর তৈরি করে দেওয়া হয়েছে, দানাদার খাদ্য দেওয়া হয়েছে, প্রদান করা হয়েছে ভ্যাকসিন ও ওষুধ। এতে করে ছাগলের রোগব্যাধি কম হয়, ছাগলের ওজন দ্রুত বৃদ্ধি পায়, ফলে মাচায় ছাগল পালন করে সংশ্লিষ্টরা অর্থনৈতিকভাবে দ্রুত লাভবান হচ্ছেন।
গরু হূষ্টপুষ্টকরণের লক্ষ্যে আগ্রহী ৩০০ জন খামারিকে হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। নির্দিষ্ট অনুপাতে পানিতে ইউরিয়া সার ও চিটাগুড় মিশিয়ে তা খড়ের ওপর ছিটিয়ে দিয়ে ইউরিয়া মোলাসেস স্ট্র (UMS) তৈরি করা হয়। এই ইউএমএসএ থাকে প্রচুর পরিমাণে নন প্রোটিন নাইট্রোজেন, যা খাওয়ানোর ফলে গরুর পাকস্থলীতে গিয়ে হজম হয়ে উক্ত নাইট্রোজেন কণা মুক্ত প্রোটিন কণায় রূপান্তরিত হয়ে রক্তে মিশে এবং দ্রুত পশুর ওজন বৃদ্ধি পায়। এ ছাড়া ইউরিয়া মোলাসেস মিনারেল ব্লক বিশেষ প্রক্রিয়ায় প্রস্তুত করেও একই পদ্ধতিতে গরু দ্রুত সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হয়। কোনো স্টেরয়েড বা হরমোন ব্যবহার ছাড়াই দেশীয় প্রযুক্তি ব্যবহার করে গরু হূষ্টপুষ্টকরণের ফলে কোরবানির জন্য বিদেশ-নির্ভরতা এখন নেই বললেই চলে। মাংসের জন্য গরু ও ছাগল উত্পাদনে কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ, যশোর, মাগুরা, নড়াইল ও খুলনা জেলার অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় অগ্রগামী।
এ প্রকল্পের ব্যতিক্রমী সংযোজন হচ্ছে প্রতি ইউনিয়নের একজন যুবকের আত্মকর্মসংস্থান সুযোগ সৃষ্টি ও একই সঙ্গে প্রত্যন্ত গ্রামে গবাদি পশুর স্বাস্থ্যসেবা প্রদান। ৬৯০ জন যুবককে তিন সপ্তাহ প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে গবাদি পশুর খামার স্থাপন ও গবাদি পশু লালনপালনে যাবতীয় কর্মকাণ্ড হাতে-কলমে শেখানো হয়েছে। এদেরকে সবাই কমিউনিটি লাইভস্টক এক্সটেনশন ভলেন্টিয়ার বলে। এরা প্রত্যেকে গবাদি পশুর টিকা প্রদান ও প্রাথমিক চিকিত্সাসেবা দিয়ে মাসে গড়ে প্রায় ১২-১৪ হাজার টাকা নিজ বাড়িতে থেকে এবং বাড়ির খেয়ে আয় করে জীবিকা নির্বাহ করছে।
কাজেই প্রকল্পের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রাণিসম্পদ প্রদর্শনী প্যাকেজের অভিজ্ঞতা সারা দেশে ছড়িয়ে দিলে দেশ ও জাতি লাভবান হবে নিঃসন্দেহে। প্রকল্প এলাকায় ৭ হাজার ৩৫০ জন খামারিকে গবাদি পশু লালনপালনে প্রশিক্ষণ প্রদানের ফলে তারাও দক্ষতার সঙ্গে গবাদি পশু লালন পালনের সুযোগ পেয়েছে। এতে করে তারা অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হচ্ছে এবং জনগণও নিরাপদ খাদ্য হিসেবে ডিম, দুধ ও মাংসের জোগান পাচ্ছে।
লেখক : প্রাণিসম্পদ উন্নয়নকর্মী