Saturday, December 7, 2024

নমুনা ভাইভা: আপনার এলাকায় কোন ফসল ভালো হয়

মো. রেজওয়ান সরদার

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাববিজ্ঞান ও তথ্যব্যবস্থা বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী মো. রেজওয়ান সরদার। ৪১তম বিসিএসে তিনি প্রশাসন ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন। তার ভাইভার অভিজ্ঞতা শুনেছেন এম এম মুজাহিদ উদ্দীন।

অনুমতি নিয়ে রুমে প্রবেশ করলাম এবং সালাম দিলাম।

চেয়ারম্যান স্যার: আপনি তো দেখি মাস্ক খুলে প্রবেশ করেছেন। 

আমি: সরি স্যার।

চেয়ারম্যান: না, আপনি তো একটা কাজ এগিয়ে রেখেছেন। আর এখন তো কোভিড নেই। আমরাও মাস্ক খুলে রয়েছি।
আমি: এক্সট্রিমলি সরি, স্যার।

চেয়ারম্যান: চিন্তার কিছু নেই। এর জন্য আপনার ভাইভায় কোনো প্রভাব পড়বে না। আপনি মো. রেজওয়ান সরদার। বাড়ি বগুড়া। কোন উপজেলায়?
আমি: স্যার কাহালু উপজেলা।

চেয়ারম্যান: আপনার এলাকায় কী কী ভালো জন্মে?
আমি: স্যার আলু, মাছের পোনা, শুকনো মরিচ ভালো হয়।

চেয়ারম্যান: শুকনো মরিচ ভালো তো; হেসে বললেন নেওয়া যায়?
আমি: জি স্যার, নিতে পারেন।

চেয়ারম্যান: আপনার প্রথম চয়েস কী?
আমি: স্যার, বিসিএস প্রশাসন ক্যাডার।

চেয়ারম্যান: দ্বিতীয় চয়েস?
আমি: স্যার, বিসিএস কর।

চেয়ারম্যান: বিসিএস শিক্ষা ক্যাডার কত নম্বর চয়েস?
আমি: স্যার, চয়েস লিস্টে ৫ নম্বরে রেখেছি।

(এরপর এক্সটারনাল-১ স্যার প্রশ্ন শুরু করলেন)

এক্সটারনাল-১: পড়ালেখা করেছেন কোথায়? 
আমি: স্যার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হিসাববিজ্ঞান ও তথ্যব্যবস্থা বিষয়ে বিবিএ ও এমবিএ সম্পন্ন করেছি।

এক্সটারনাল-১: এখন কোথাও কর্মরত আছেন? 
আমি: জি স্যার, বর্তমানে ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি লি.-এ (ডেসকো) সহকারী ব্যবস্থাপক পদে কর্মরত আছি।

এক্সটারনাল-১: আপনাকে তাহলে দ্বিতীয় চয়েস থেকেই প্রশ্ন করি। বলুন তো এখন ট্যাক্স টু ট্যাক্স জিডিপি রেশিও কত?
আমি: স্যার বর্তমানে ৭.৫০ শতাংশ, যা আমাদের বর্তমান উদীয়মান অর্থনীতির ক্ষেত্রে তুলনামূলক কম।

এক্সটারনাল-১: হ্যাঁ, দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে কম। এটি বাড়ানোর জন্য আমরা কী করতে পারি?
আমি: স্যার, স্কোপ অব ট্যাক্স বাড়াতে হবে। যেমন–স্যার, ট্যাক্স অফিস উপজেলা পর্যন্ত বিস্তৃত করা যেতে পারে। ট্যাক্সেসন সিস্টেমকে আরও অটোমেটেড করতে হবে। ঘরে বসে যাতে ট্যাক্স রিটার্ন জমা ও ট্যাক্স দেওয়া যায়, সে ব্যবস্থা করতে পারলে মানুষ ট্যাক্স দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবে। তা ছাড়া ইনকাম ট্যাক্স পরিশোধ নিয়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। স্যার, অনুমতি দিলে এ বিষয়ে আমার একটা অবজারভেশন তুলে ধরতে চাই।

মো. রেজওয়ান সরদারমো. রেজওয়ান সরদারএক্সটারনাল-১: জি বলুন।
আমি: ঢাকায় যেখানে আমি থাকি, গোপীবাগ, মতিঝিলে রাস্তার ওপরে ভ্যানে করে একজন পেয়ারা বিক্রেতা এক কেজি পেয়ারা বিক্রি করেন ৬০-৭০ টাকায়। তিনি পাইকারি কেনেন ৩০ টাকা করে। অন্যান্য খরচ বাবদ যদি তাঁর আরও ১০ টাকাও লাগে, তাহলে প্রতি কেজিতে তিনি ২০-৩০ টাকা লাভ করছেন। যদি গড়ে তিনি ১০০ কেজি পেয়ারা মাসে ২০ দিনও বিক্রি করেন, তবুও তাঁর মাসিক লাভ ৪০ হাজার টাকা। But he is not taxed. আমরা তাঁকে ট্যাক্সের আওতায় আনতে পারছি না, কিন্তু একজন নবম গ্রেডের কর্মকর্তা সর্বসাকল্যে মাসিক ৩৫ হাজার টাকা পেয়েও ৫ হাজার টাকা ন্যূনতম ট্যাক্স দিচ্ছেন। স্যার, এমন ৮০ শতাংশ মানুষ কাজ করে আমাদের ইনফরমাল সেক্টরে, তাঁদের যদি যথাযথ সুবিধা দিয়ে ব্যাংকিং চ্যানেলেও আনা যেত, তবে আমরা কিন্তু অনেক ট্যাক্স আয় করতে পারতাম।

এক্সটারনাল-১: বাহ। সুন্দর বলেছেন। অসমাপ্ত আত্মজীবনী পড়েছেন?
আমি: জি স্যার।

এক্সটারনাল-১: বইটি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কোন সময়ে রচিত?
আমি: ১৯৬৭-৬৯ সালে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী থাকার সময় তিনি লেখেন।

এক্সটারনাল-১: এই বই থেকে দুটি ঘটনা বলতে পারবেন, যা আপনার মনে দাগ কেটেছে?
আমি: ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে বন্দী থাকাকালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অত্যাচার, জুলুম, ভাষার ওপর নিপীড়নের প্রতিবাদস্বরূপ অনশন করেন। তা ছাড়া পাকিস্তানি গোয়েন্দাদের তথ্যমতে, শেখ মুজিব ঢাকা জেলে থেকে অনশনের মাধ্যমে বাইরের আন্দোলনকে উসকে দিচ্ছেন মর্মে তাঁকে ও তাঁর তৎকালীন জেলসঙ্গী মহিউদ্দিন সাহেবকে ঢাকা জেল থেকে ফরিদপুর জেলে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়। তাঁদের জেলগেটে নেওয়া হলে জমাদার কাপড়চোপড় ও বইপত্র নিয়ে আসে। নারায়ণগঞ্জ স্টিমার ঘাট দিয়ে ফরিদপুর যাওয়া হবে। বঙ্গবন্ধু কাপড়চোপড়, বইপত্র ইচ্ছে করে এলোমেলো করে আবার গোছাচ্ছিলেন যাতে করে কালক্ষেপণ করা যায় এবং এ খবর যাতে পরিচিত ঢাকায় কাউকে জানানো যায়।

এক্সটারনাল-১: বঙ্গবন্ধুকে সম্ভবত বন্দী অবস্থায় ঢাকা জেল থেকে না; বরং হাসপাতাল থেকে তাঁকে নেওয়া হয়। 
আমি: জি স্যার (অযথা হ্যাঁ-বোধক জি বলছি)। স্যার, আসলে অনেক আগে বইটা পড়েছি তাই সঠিক মনে পড়ছে না, সরি স্যার।

এক্সটারনাল-২: বাংলাদেশ তো এলডিসি থেকে গ্র্যাজুয়েশন করবে। এই স্ট্যাটাসটা কে দেয়?
আমি: স্যার, UNCDP-এর ইকোসোক (ECOSOC)।

এক্সটারনাল-২: ভেরি গুড। এতে আমাদের কী কী চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হবে?
আমি: এলডিসি থেকে গ্র্যাজুয়েশনের ফলে বিশ্ব মানচিত্রে যদিও আমাদের ভাবমূর্তির অনেক উন্নতি হবে, তবে কিছু চ্যালেঞ্জেরও সম্মুখীন হতে হবে। যেমন–বাংলাদেশ কিছু পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে শুল্কমুক্ত অ্যাকসেস হারাবে, জিএসপি সুবিধা হারাবে, সহজ শর্তে ঋণের পরিমাণ কমবে, ওষুধশিল্পে মেধাস্বত্ব ব্যবহারের নমনীয়তা থাকবে না।

এক্সটারনাল-২: সে ক্ষেত্রে কী করা যায়?
আমি: স্যার, যেহেতু বিশ্বে আমাদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে, সুতরাং বিনিয়োগ বাড়াতে হবে, বিশেষ করে এফডিআই। স্যার, ইতিমধ্যে আমাদের বর্তমান সরকার বেজার নেতৃত্বে ১০০টি স্পেশাল ইকোনমিক জোন করছে, সেখানে বাইরের বিনিয়োগ আনতে হবে। এরপর স্যার বিভিন্ন দেশের সঙ্গে পিটিএ (PTA) এবং এফটিএ (FTA) করতে হবে। এক্সপোর্ট বাস্কেটটা বাড়াতে হবে। আমাদের বিভিন্ন সম্ভাবনাময় পণ্য রয়েছে, যেমন–লেদার আইটেমস, লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং, সিরামিক, প্লাস্টিক পণ্য, আইসিটি ইত্যাদি পণ্য রপ্তানি বাড়াতে হবে। আমরা Demographic Dividend-এর দেশ। প্রায় ১১ কোটি মানুষ কর্মক্ষম। এখান থেকে দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তুলতে হবে। তাহলে স্যার আমরা ভিশন-২০৪১ অর্জন করতে পারব।

এক্সটারনাল-২: আপনি তো ডিপিডিসিতে আছেন না?
আমি: না স্যার, ডেসকোতে।

চেয়ারম্যান: নবায়নযোগ্য জ্বালানির সোর্স কী কী হবে?
আমি: স্যার, হাইড্রো ইলেকট্রিসিটি, সোলার এনার্জি, বায়ুবিদ্যুৎ, বায়োগ্যাসের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যেতে পারে। তবে স্যার, সৌরবিদ্যুতের ওপর বেশি জোর দেওয়া হচ্ছে, যদিও এর জন্য অনেক জমির প্রয়োজন। যেমন–স্যার, ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ৪০০ একর জমির প্রয়োজন, যা আমাদের মতো ডেন্সলি পপুলেটেড দেশের জন্য কষ্টকর।

চেয়ারম্যান: তাহলে কী করা যায়?
আমি: স্যার, ডেসকো কোনো বাসায়, যেমন–নতুন কানেকশনের জন্য শর্ত দেয় ছাদে সোলার স্থাপন করতে হবে, আবার রাজউক তাদের প্ল্যানে ছাদে সোলার স্থাপনের শর্ত প্রদান করে।

চেয়ারম্যান: এতে তো তেমন কিছু হয় না।
আমি: জি স্যার। তবে নতুন-আপগ্রেডেড প্রযুক্তির ভিত্তিতে পতিত জমিতে বা একসঙ্গে ফসলি জমিতেও কিন্তু সোলার স্থাপন করা যায়। যেমন–নর্থ ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি লি.-এর সবজির পাশাপাশি সোলার স্থাপন করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়েছে।

চেয়ারম্যান: আসলে এখানে অনেক বিনিয়োগ দরকার।
আমি: জি স্যার।

চেয়ারম্যান: স্মার্ট বাংলাদেশের কয়টা পিলার?
আমি: স্যার, চারটি।

চেয়ারম্যান: কী কী?
আমি: স্মার্ট সিটিজেন, স্মার্ট সোসাইটি, স্মার্ট গভর্নমেন্ট ও স্মার্ট ইকোনমি।

চেয়ারম্যান: স্মার্ট সিটিজেন কী?
আমি: স্যার, যখন কোনো সিটিজেন তাঁর হাতের মুঠোয় থাকা স্মার্টফোন বা বিভিন্ন অ্যাপ ব্যবহার করে কোনো সেবা চায়। যেমন–স্যার, এনআইডিতে কোনো ভুল সংশোধনের জন্য সার্ভারে গিয়ে আবেদন করা, রেলসেবার মাধ্যমে রেলের টিকিট কাটা, ই-নামজারির আবেদন করা।

চেয়ারম্যান: বলুন তো, সামাজিক দায়বদ্ধতা কী?
আমি: স্যার, আমরা যে সমাজে বসবাস করি, যার আলো-হাওয়ায় বেড়ে উঠি, সেই সমাজের প্রতি আমাদের দায়বদ্ধতা রয়েছে, যার ফলে আমরা সমাজের ভালোর জন্য নানান কাজ করি।

চেয়ারম্যান: যেমন?
আমি: যেমন স্যার বিদ্যুৎ যথাযথ ব্যবহার করা, গ্যাস-পানি ব্যবহারে সচেতন হওয়া, সবকিছুই সামাজিক দায়বদ্ধতার অংশ।

চেয়ারম্যান: আর?
আমি: আসলে সামাজিক দায়বদ্ধতা বলতে স্যার, যে যখন যেখানে রয়েছে, সমাজের ভালোর জন্যই কাজ করা। যেমন–একটু আগে আমাকে বিস্কুট খেতে দেওয়া হয়েছিল, খাওয়ার পর প্যাকেটটি ডাস্টবিনে ফেলাও আমার সামাজিক দায়বদ্ধতা।

এক্সটারনাল-১: বঙ্গবন্ধুর একটা বিখ্যাত উক্তি শুনেছেন, ‘এ স্বাধীনতা আমার ব্যর্থ হয়ে যাবে, যদি আমার বাংলার মানুষ পেট ভরে ভাত না খায়। এই স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না, যদি বাংলার মা-বোনেরা কাপড় না পায়। এ স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না যদি এ দেশের মানুষ, যারা আমার যুবক শ্রেণি আছে, তারা চাকরি না পায় বা কাজ না পায়।’

আমি: জি স্যার, শুনেছি। স্যার, এভাবেই তো জাতির পিতার সোনার বাংলা গড়ে উঠবে।
চেয়ারম্যান: ঠিক আছে রেজওয়ান, এখন আসতে পারেন।

আমি: হেসে ধন্যবাদ ও সালাম দিয়ে বের হয়ে এলাম।

মো. রেজওয়ান সরদার, প্রশাসন ক্যাডার, ৪১তম বিসিএস (সুপারিশপ্রাপ্ত)

spot_imgspot_img

ছবিটা তুলে রাখুন ঐতিহাসিক হয়ে থাকবে : ড. ইউনূস

গ্রামীণ টেলিকমের শ্রমিক-কর্মচারীদের কল্যাণ তহবিলের ২৫ কোটি টাকা আত্মসাৎ এবং পাচারের অভিযোগে করা মামলায় জামিন পেয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান ও নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস।...

মায়ের ঘুমপাড়ানি সুর শান্তিধারা

আমাদের জোনাকজ্বলা গ্রাম বিদ্যুৎ তখনও দেখেনি। সন্ধ্যার কাছে বিকেল নতজানু হতেই সবুজ পাহাড়েরা মিশকালো হয়ে যায়। ফলে- আমরা চালের ফুটো দিয়ে চাঁদ দেখি, আর...

মাহবুবা ফারজানা নতুন তথ্য সচিব

তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের নতুন সচিব হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন বেগম মাহবুবা ফারজানা। তিনি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) ছিলেন। তাকে সচিব পদে পদোন্নতি...

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here