জ্ঞান আহরণের একটি মাধ্যম শ্রবণ করা। ভালো আলোচনা শুনলে ব্যক্তির জ্ঞানভাণ্ডার সমৃদ্ধ হয়। ইসলাম মানুষকে ভালো শ্রোতা হওয়ার নির্দেশনা দেয়। পবিত্র কোরআনের একাধিক আয়াতে মনোযোগী শ্রোতা হওয়ার অনুপ্রেরণা পাওয়া যায়।
আল্লাহ সর্বশ্রোতা
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ নিজেকে শ্রবণের গুণে গুণান্বিত করেছেন। আল্লাহর অন্যতম গুণবাচক নাম হলো ‘সামিউন’ বা শ্রোতা। ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা আল্লাহকে ভয় কোরো।
রাসুলুল্লাহ (সা.) ছিলেন শ্রবণকারী
পবিত্র কোরআনে নবীজি (সা.)-এর যেসব বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা হয়েছে তার একটি ‘শ্রবণকারী’। যদিও মুশরিকরা তাঁকে কষ্ট দিতে এমন শব্দ ব্যবহার করত। কিন্তু আল্লাহ তা প্রশংসায় রূপান্তরিত করেন।
ভালো শ্রোতা হওয়ার অনুপ্রেরণা
কোরআন ও হাদিসের নির্দেশ, নির্দেশনা ও বর্ণিত ঘটনাবলি থেকে ভালো শ্রোতা হওয়ার অনুপ্রেরণা পাওয়া যায়। নিম্নে এমন কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করা হলো—
১. আল্লাহ শয়তানের কথাও শুনেছেন : পবিত্র কোরআনের একাধিক স্থানে শয়তানের অবাধ্যতার বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। যেখানে শয়তান আল্লাহর অবাধ্যতার ঘোষণা দিয়েছে, অথচ আল্লাহ তার মুখ বন্ধ করে দেননি; যা মানুষকে ভালো শ্রোতা হওয়ার অনুপ্রেরণা দেয়।
২. শত্রুদের কথাও শুনতেন নবীজি (সা.) : রাসুলুল্লাহ (সা.) ছিলেন একজন আদর্শ শ্রোতা। তিনি তাঁর শত্রুদের কথাও মনোযোগ দিয়ে শুনতেন। দীর্ঘ হাদিসে এসেছে, একবার কুরাইশের পক্ষ থেকে উতবা ইবনে রাবিয়া রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে এলো। সে নবীজি (সা.)-কে অর্থ-সম্পদ, নারী ও নেতৃত্বের প্রলোভন দেখিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করল। তিনি তাঁর কথা শুনলেন এবং বক্তব্য শেষে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার কথা শেষ? সে বলল, হ্যাঁ। তিনি তখন সুরা ফুসসিলাতের প্রথম ১৩ আয়াত তিলাওয়াত করলেন। (মাজমাউল জাওয়ায়িদ : ৬/২২)
৩. মুমিন আদর্শ শ্রোতা : আদর্শ মুমিন, আদর্শ শ্রোতা। পবিত্র কোরআনে মুমিনের বৈশিষ্ট্য এভাবে বর্ণনা করা হয়েছে, ‘আর তারা বলে, আমরা শুনেছি এবং পালন করেছি। হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা তোমার ক্ষমা চাই আর প্রত্যাবর্তন তোমারই কাছে।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ২৮৫)
উল্লিখিত আয়াতের ব্যাখ্যায় আলেমরা বলেন, মুমিন যখন মনোযোগসহ কোরআন ও সুন্নাহর কথা শোনে, তখন সে অন্তরে আল্লাহর আনুগত্যের অনুপ্রেরণা লাভ করে।
৪. অবিশ্বাসীরা শ্রবণে অমনোযোগী : মুমিন শ্রবণে মনোযোগী হয়, বিপরীতে অবিশ্বাসীরা শ্রবণে অমনোযোগী হয়। ইরশাদ হয়েছে, ‘হে মুমিনরা! আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের আনুগত্য কোরো এবং তোমরা যখন তার কথা শ্রবণ করছ, তখন তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ো না। এবং তোমরা তাদের মতো হয়ো না, যারা বলে, শ্রবণ করলাম, বস্তুত তারা শ্রবণ করে না।’ (সুরা : আনফাল, আয়াত : ২০-২১)
৫. মনোযোগী শ্রোতা সহজে সুপথ লাভ করে : যারা শ্রবণে মনোযোগী, তাদের পক্ষে সুপথ লাভ করা সহজতর। মহান আল্লাহ বলেন, ‘যারা মনোযোগসহ কথা শোনে এবং তার মধ্যে যা উত্তম তা গ্রহণ করে, তাদেরকে আল্লাহ সৎপথে পরিচালিত করেন এবং তারাই বোধশক্তিসম্পন্ন।’ (সুরা : ঝুমার, আয়াত : ১৮)
শুনতে হবে পিছিয়ে পড়া মানুষের কথাও
একাধিক বিশুদ্ধ সনদে বর্ণিত, অন্ধ সাহাবি আবদুল্লাহ বিন মাকতুম (রা.) রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে কোনো একটি আরজি নিয়ে এসেছিলেন। তখন নবীজি (সা.)-এর কাছে একজন কুরাইশ নেতা উপস্থিত ছিলেন। তিনি তাঁর হিদায়াত লাভের ব্যাপারে আশাবাদী ছিলেন। ফলে তিনি আবদুল্লাহ বিন মাকতুম (রা.)-এর তুলনায় কুরাইশ নেতার প্রতি বেশি মনোযোগী ছিলেন। তখন আল্লাহ নবীজি (সা.)-কে সতর্ক করে বলেন, ‘সে ভ্রুকুঞ্চিত করল এবং মুখ ফিরিয়ে নিল। কেননা তাঁর কাছে অন্ধ লোকটি এসেছে। তুমি কেমন করে জানবে—সে পরিশুদ্ধ হতো অথবা উপদেশ গ্রহণ করত, ফলে উপদেশ তার উপকারে আসত।’ (সুরা : আবাসা, আয়াত : ১-৪)
ভালো কথা শোনার পুরস্কার
আল্লাহ ভালো কথা মনোযোগ দিয়ে শুনলে তার জন্য পুরস্কার ঘোষণা করেছেন। আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি জুমার দিন গোসল করে এবং যথাসম্ভব উত্তমরূপে পবিত্রতা অর্জন করে, অতঃপর তেল মেখে নেয় অথবা সুগন্ধি ব্যবহার করে। এরপর মসজিদে যায়, দুইজনের মধ্যে ফাঁক করে না এবং তার ভাগ্যে নির্ধারিত পরিমাণ নামাজ আদায় করে। আর ইমাম যখন খুতবার জন্য বের হন, তখন চুপ থাকে। তার এ জুমা এবং পরবর্তী জুমার মধ্যবর্তী সব গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হয়। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৯১০)
অন্যের শ্রবণেও বাধা নয়
ইসলাম যেমন ব্যক্তিকে ভালো কথা মনোযোগসহ শুনতে বলেছে, অন্যরাও যেন তা শুনতে পারে সে পরিবেশ রক্ষার নির্দেশনা দিয়েছে। পবিত্র কোরআনে সেসব মানুষের নিন্দা করা হয়েছে, যারা অন্যের শ্রবণের ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করে। ইরশাদ হয়েছে, ‘অবিশ্বাসীরা বলে, তোমরা এই কোরআন শ্রবণ কোরো না এবং তা আবৃত্তিকালে শোরগোল সৃষ্টি কোরো, যাতে তোমরা জয়ী হতে পারো। আমি অবশ্যই অবিশ্বাসীদের কঠিন শাস্তি আস্বাদন করাব এবং নিশ্চয়ই আমি তাদেরকে তাদের নিকৃষ্ট কাজের প্রতিফল দেব।’ (সুরা : হা-মিম-সাজদা, আয়াত : ২৬-২৭)
দ্বিনের কথা শ্রবণই যথেষ্ট নয়
দ্বিনের কথা শ্রবণ করাই যথেষ্ট নয়, বরং তা উপলব্ধি করা এবং আমল করা আবশ্যক। যারা দ্বিনের কথা শুনেও উপলব্ধি করে না, তারা বধিরতুল্য। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তাদের মধ্যে কেউ কেউ তোমার দিকে কান পেতে রাখে। তুমি কি বধিরকে শুনাইবে, তারা না বুঝলেও?’ (সুরা : ইউনুস, আয়াত : ৪২)
মন্দ কথা শ্রবণ করা নিষিদ্ধ
মন্ধ কথা বলা ও শোনা উভয়টি নিষিদ্ধ। মহান আল্লাহ বলেন, ‘মন্দ কথার প্রচারণা আল্লাহ পছন্দ করেন না, তবে যার ওপর জুলুম করা হয়েছে সে ছাড়া। আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ১৪৮)
মন্দর কথার আসর পরিহারযোগ্য
কোনো স্থানে মন্দ কথা হলে ইসলাম সেই স্থান ত্যাগ করতে বলে, যেন মন্দ কথা শুনতে না হয়। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তুমি যখন দেখ, তারা আমার আয়াতগুলো সম্পর্কে উপহাসমূলক আলোচনায় মগ্ন হয়, তখন তুমি তাদের থেকে সরে পড়বে, যে পর্যন্ত না তারা অন্য প্রসঙ্গে প্রবৃত্ত হয় এবং শয়তান যদি তোমাকে ভ্রমে ফেলে, তবে স্মরণ হওয়ার পরে জালিম সম্প্রদায়ের সঙ্গে বসবে না।’ (সুরা : আনআম, আয়াত : ৬৮)
ভালো শ্রোতা হতে চাই অনুশীলন
ব্যক্তিজীবনের অন্য গুণাবলির মতো ভালো শ্রোতা হওয়ার জন্য প্রয়োজন অনুশীলন। মনোযোগসহ অন্যের কথা শুনতে থাকলে একসময় ভালো শ্রোতা হওয়া সম্ভব। আরবি ভাষার একটি বিখ্যাত উদ্ধৃতি হলো, ‘তোমরা যেভাবে সুন্দরভাবে কথা বলতে শেখো, তেমনি সুন্দরভাবে কথা শোনার শিক্ষা গ্রহণ কোরো।’
আল্লাহ সবাইকে উত্তম কথার ভালো শ্রোতা হওয়ার তাওফিক দিন। আমিন।