দেশের সড়কগুলো নিরাপদ করতে নেওয়া নিরাপদ সড়ক প্রকল্পের কাজ চলছে ধীরগতিতে। গত বছরের মে মাসে শুরু হওয়া ৪ হাজার ৯৮৮ কোটি টাকার এই প্রকল্পে এখনো সব পরামর্শকই নিয়োগ হয়নি। প্রেষণে সব কর্মকর্তা দেওয়ার কথা থাকলেও এমন আছেন মাত্র সাতজন। বাকিরা অতিরিক্ত দায়িত্বে।
এই প্রকল্পে বিশ্বব্যাংক ৩ হাজার ৭০৭ কোটি টাকা ঋণ হিসেবে দিচ্ছে। বাকি টাকার জোগান দিচ্ছে সরকার। পদ্মা সেতু প্রকল্প থেকে সরে যাওয়ার পর বিশ্বব্যাংক বিগত আওয়ামী লীগের ১৫ বছরে এই একটিমাত্র প্রকল্পে অর্থায়ন করছে। প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৮ সালের জুন। প্রকল্পসংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব জানা গেছে।
প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা বলছেন, সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (সওজ), বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ), স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ পুলিশ—এই চার সংস্থা আলাদাভাবে সড়ক নিরাপদ করার লক্ষ্যে কাজ করবে। প্রকল্পের শুরুতে পাইলট প্রকল্প হিসেবে জয়দেবপুর-এলেঙ্গা মহাসড়ক ও নাটোর-রাজশাহী মহাসড়ক নিয়ে সংস্থাগুলো কাজ করছে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ড. শামছুল হক বলেন, এই প্রকল্প নেওয়া হয়েছে মূলত বিদেশি দাতাগোষ্ঠীর আগ্রহে। তাদের নানা রকম অর্থনৈতিক স্বার্থ থাকে। বাস্তবায়নকারী বিভিন্ন সংস্থারও নানা স্বার্থ থাকে। তিনি বলেন, এর আগে বাংলাদেশ পুলিশ সড়ক নিরাপত্তার জন্য তিনটি প্রকল্প নিয়েছে। সেগুলো মুখ থুবড়ে পড়েছে। বিপুল ব্যয়ে কিছু অবকাঠামোগত উন্নয়ন করলেই সড়কে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায় না। পুলিশ, বিআরটিএ, সওজ—সব পক্ষকে সড়ক আইন বাস্তবায়নে আরও সক্রিয় ও সমন্বিত উপায়ে কাজ করতে হবে।
সূত্র বলেছে, প্রকল্পে ব্যয়ের ১ হাজার ২৩৮ কোটি টাকা দিচ্ছে সরকার। প্রকল্পের অধীনে সড়ক নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদারের লক্ষ্যে উন্নত প্রকৌশল নকশা, পথচারীর জন্য সুবিধা, সংকেত ও চিহ্ন স্থাপন, গতিসীমা নির্ধারণ এবং জরুরি সেবা বাস্তবায়ন করা হবে। এসব ব্যবস্থায় পাইলট প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত দুটি মহাসড়কে দুর্ঘটনায় মৃত্যুহার কমপক্ষে ৩০ শতাংশ কমাতে সহায়ক হবে বলে আশা প্রকল্পসংশ্লিষ্টদের।
বিপুল ব্যয়ে কিছু অবকাঠামোগত উন্নয়ন করলেই সড়কে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায় না। সড়ক আইন বাস্তবায়নে আরও সক্রিয় ও সমন্বিত উপায়ে কাজ করতে হবে। ড. শামছুল হক অধ্যাপক, বুয়েট
প্রকল্পের অংশ হিসেবে বিআরটিএ জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম বাড়ানোর পাশাপাশি ৬০ হাজার দক্ষ চালক তৈরি করবে। পুলিশ সমন্বিত ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা ও দুর্ঘটনা চিহ্নিত করার ব্যবস্থা চালু করবে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, টাঙ্গাইল জেনারেল হাসপাতাল, মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগ সংস্কার করবে এবং দুর্ঘটনায় গুরুতর আহতদের চিকিৎসায় নার্সদের আধুনিক প্রশিক্ষণ ও একটি জরুরি কল সেন্টার স্থাপন করবে।
প্রকল্প সূত্র বলছে, প্রকল্পটি বাস্তবায়নে বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণে প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে ২ হাজার ৭৩৪ কোটি টাকা; বিভিন্ন মালপত্র কেনাকাটায় প্রাক্কলিত ব্যয় ২০৯ কোটি ৫৬ লাখ টাকা। ভূমি অধিগ্রহণ খাতে ৪০১ কোটি ৪৪ লাখ টাকা, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দক্ষতা বাড়াতে প্রশিক্ষণ ও তাঁদের নানা কার্যক্রমে ১২৯ কোটি ৫৪ লাখ টাকা, প্রকল্পের প্রচার খাতে প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে ৪২ কোটি ৬২ লাখ টাকা। পরামর্শক খাতে ব্যয় ২১৯ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। এতে সওজ ছাড়াও বিআরটিএ, বাংলাদেশ পুলিশ ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরামর্শকদের ব্যয়ও অন্তর্ভুক্ত। মার্কিন ডলারের মূল্যবৃদ্ধি বা বিশ্ববাজারে পণ্যের দামের সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতে ৩৪০ কোটি ১০ লাখ টাকা আলাদাভাবে বরাদ্দ করা হয়েছে।
প্রকল্প পরিচালক মো. আমান-উল্লাহ জানান, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে প্রকল্পটিতে সরকার ১ কোটি ৫২ লাখ টাকা বরাদ্দ করে। অটোমেশন খাত থেকে এসেছে ৭৩ লাখ টাকা। বিগত অর্থবছরে প্রকল্পের অগ্রগতি শূন্য দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে প্রকল্পে এডিপি বরাদ্দ ৬৭ কোটি ৯৩ লাখ টাকা। এই অর্থবছরে সরকার ছাড় করেছে ২৭ কোটি ৯৩ লাখ টাকা। অটোমেশন থেকে এসেছে ৪০ কোটি টাকা। অগ্রিম অর্থছাড় হয়েছে ২০৯ কোটি টাকা, যা গত জুনে একটি ব্যাংকে রাখা হয়েছে।
প্রকল্প সূত্র জানায়, পাইলট প্রকল্পের দুটি মহাসড়কের পরিকল্পনাগত বিষয় নিয়ে কাজ করবে সওজ; যানবাহনের লাইসেন্স, ফিটনেস নিয়ে কাজ করবে বিআরটিএ; দুর্ঘটনার পর যাত্রীর সেবা নিয়ে কাজ করবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং সড়কে নিরাপত্তা ও নজরদারি নিয়ে কাজ করবে পুলিশ। এই চার সংস্থার জন্য নিয়োগ দিতে হবে ১২ পরামর্শক। তবে এ পর্যন্ত নিয়োগ হয়েছে পাঁচ পরামর্শক। এর মধ্যে ওই দুই মহাসড়কের জরিপ নিয়ে কাজ করছে একটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান। তাদের জরিপ শেষে সেটি নিয়ে আলাদা ডিজাইন করবে আরেকটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান। তবে ওই পরামর্শক এখনো নিয়োগ হয়নি। এ ছাড়া ঢাকা, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, খুলনা, রংপুর বিভাগের ৫ হাজার ২০০ কিলোমিটার সড়ক জরিপ করা হবে। পরে সেগুলোর মান কমপক্ষে থ্রি স্টার করা হবে।
প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রকল্প প্রস্তাবে (ডিপিপি) ওই চার সংস্থার কর্মকর্তাদের প্রকল্পে প্রেষণে দিতে বলা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে প্রকল্প পরিচালকসহ সওজের শুধু ৭ জন কর্মকর্তা প্রেষণে এসেছেন। বাকি ৪২ কর্মকর্তা অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে প্রকল্পে আছেন। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন সওজের ১৬ জন, পুলিশের ১৩, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ৬ ও বিআরটিএর ৭ কর্মকর্তা। অধিকাংশ কর্মকর্তা অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে প্রকল্পে আসায় সমন্বয়ে সমস্যা হচ্ছে। অতিরিক্ত দায়িত্ব পাওয়া কর্মকর্তারা সার্বক্ষণিক প্রকল্পের কাজে সম্পৃক্ত নন, শুধু ডাকলেই আসেন। তবে ডাকলেও কেবল সংস্থাগুলোর একজনকে পাঠানো হয়।
জানতে চাইলে প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক মো. আমান-উল্লাহ বলেন, পরামর্শক নিয়োগ ও জরিপ পর্যায়ে কাজ চলছে। অন্যান্য সংস্থার কর্মকর্তারা অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে কাজ করছেন। ২৮ অক্টোবর প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করে তাঁকে প্রকল্প নিয়ে বিস্তারিত জানানো হবে। (এ.এম.এম.জামী)